আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমার এই মূল্যবান বক্তৃতার বাকি অংশ না হয় আরেকদিন শোনা যাবে। আজকে আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। এখনো দাঁত মাজিনি। মুখ ধুইনি। কিছু মুখেও তো দিতে হবে। খালি পেটে কি আর লেকচার ভালো লাগে? স্পষ্টই মাসুম বিরক্ত হলো। তার জ্বলন্ত উৎসাহে বাধা পড়েছে। আপনি যতো বড়ো বড়ো কথাই বলুন না কেনো, ভেতরে ভেতরে একটি পেটি বুর্জোয়া। আমি বললাম, তোমার এই শ্রেণী বিশ্লেষণের কাজটিও আরেকদিন করতে হবে। আপাততঃ নরেশদা কোথায় আছেন, সংবাদটা জানিয়ে আমাকে বাধিত করো। কি জানি এখন কোথায় আছেন। কিছুক্ষণ আগে তো দেখলাম রাঁধুনি চিত্তের সঙ্গে ঘুটুর ঘুটুর করে কি সব কথাবার্তা বলছেন। দানিয়েল ভাই জানেন, এই নরেশদা লোকটার ওপর আমার ভয়ানক রাগ হয়। আপনার সঙ্গে তবু কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলা যায়, নরেশদা গাছের মতো মানুষ। কোনো ব্যাপারেই কোনো রিএ্যাকশন নেই।
আমি গামছাটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেলাম। চাপাকলের গোড়ায় দেখি কোনো ভিড় নেই। দুটো মাত্র চাপাকল একশো দেড়শো জন ছাত্রের প্রয়োজন মেটাবার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। গোসলের সময়টিতেও একটা তীব্র কম্পিটিশন লেগে যায়। প্রথম প্রথম এখানে গোসল করতে আসতে ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করতাম। কারণ, হোস্টেলের ছাত্রদের অনেকেরই আসল নিবাস পূর্ববাংলা, তথা বাংলাদেশ। কারো কারো মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তবে এ কথা সত্যি যে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশের অত্যাচারে এদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। অনেকের গায়ে টোকা দিলেই গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ এসকল এলাকার গন্ধ পাওয়া যাবে। জীবন্ত ছাগল থেকে চামড়া তুলে নিলে যে অবস্থা হয়, এদের দশাও অনেকটা সে রকম। কোলকাতা শহরে থাকে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে ঢেউ খেলছে পূর্ববাংলার দীঘল বাঁকের নদী, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, হাটঘাট, ক্ষেতফসল, গরুবাছুর। আমি গোসল করতে গেলেই নিজেরা বলাবলি করতো, কীভাবে একজনের বোনকে মুসলমান চেয়ারম্যানের ছেলে অপমান করেছে। অন্যজন বলতে পাশের গায়ের মুসলমানেরা এক রাতের মধ্যে ক্ষেতের সব ফসল কেটে নিয়ে গেছে।
ছোটোখাটো একটি ছেলে তো প্রায় প্রতিদিন উর্দু পড়াবার মৌলবীকে নিয়ে নতুন কৌতুক রচনা করতো। ভাবতাম আমাকে নেহায়েত কষ্ট দেয়ার জন্যই এরা এসব বলাবলি করছে। অথচ মনে মনে প্রতিবাদ করারও কিছু নেই। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য। উঃ সংখ্যালঘু হওয়ার কি যন্ত্রণা! তাদের কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হতো সুলতান মাহমুদ, আলাউদ্দিন খিলজী থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত যতো অত্যাচার হিন্দুদের ওপর হয়েছে তার জন্য যেনো আমিই অপরাধী। মাঝে মাঝে ভাবতাম, বার্মা কি আফগানিস্তান কোথাও চলে যাওয়া যায় না।
এখন অবশ্য আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন এসেছে। যেখানেই পৃথিবীর দুর্বলের ওপর অত্যাচার হয়, মনে হয়, আমি নিজেও তার জন্য অল্প বিস্তর দায়ী। কেনো এসব অনুভূতি হয় বলতে পারবো না। এখন আমাকে সবাই সমাদর করে। আমি অসুস্থ মানুষ বলে কেউ কেউ আমাকে বালতিতে পানি ভরতি করে দিয়ে যায়। সম্যক পরিচয়ের অভাবই হচ্ছে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের মূল।
আমি গোসল সেরে এসে দেখি, নরেশদা কাপড়চোপড় পরে একমাত্র কাঠের চেয়ারখানার ওপরে ব্যালকনির দিকে মুখ করে বসে রয়েছেন। ঘরে আমার পূর্বপরিচিত জয়সিংহ ব্যানার্জী তাঁর যজমানের মেয়েটিকে নিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছেন। এই জয়সিংহ ব্যানার্জীর সঙ্গে বাংলাবাজারে আমার পরিচয়। একটা ছোটো বইয়ের দোকান চালাতো। ব্রাহ্মণ জানতাম। কিন্তু যজমানি পেশাটাও একই সঙ্গে করছে, জানতে পারলাম কোলকাতা এসে। প্রিন্সেপ স্ট্রীটে দেখা, সঙ্গে একটি মেয়ে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো যজমানকন্যা। নরেশদা বোধ হয় জয়সিংহ ব্যানার্জী মানুষটিকে ঠিক পছন্দ করতে পারেননি। এই অপছন্দের কারণ, জিগগেস করতে যেয়েও করতে পারিনি। কতোজনের কতো কারণ থাকে। ওদের আজকে যে আসার কথা দিয়েছিলাম, সে কথা মনেই ছিলো না। আমার পায়ের শব্দে নরেশদা পেছনে ফিরে তাকালেন। এতো দেরি করলে যে। আমি বললাম, দেরি আর কোথায় করলাম। ঘুম থেকে উঠতেই দেরি হয়ে গেলো। তার ওপর মাসুমের আস্ত একখানি লেকচার হজম করতে হলো। টিফিন করতে যাবে না? সে কি আপনি সকাল থেকে কিছু না খেয়েই বসে আছেন? তিনি বললেন, তুমি কি মনে করো? মনে করাকরি নিয়ে কাজ নেই। চলুন।
জয়সিংহ ব্যানার্জীকে বললাম, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, এই আমরা কিছু খেয়েই চলে আসবো। নরেশদা বললেন, উনারাও সঙ্গে চলুক। আমাকে তো রুম বন্ধ করে যেতে হবে আর তো কেউ নেই। পাহারা দেবে কে? আমি যাবো আমার কাজে, তোমাকেও বোধ হয় বেরোতে হবে। অতএব কাপড়চোপড় পরে একেবারে তৈরি হয়ে নেয়াই উত্তম। মনে আছে তো তিনটের সময় তোমাকে কোথায় যেতে হবে? আমার শরীরে একটা প্রদাহ সৃষ্টি হলো। বললাম, চলুন, চলুন। রাস্তার ওপাশের ছোট্টো অবাঙালি দোকানটিতে যেয়ে পুরি তরকারি খেয়ে নিলাম। জয়সিংহ ব্যানার্জী এবং তাঁর যজমানকন্যা কিছুতেই খেতে রাজি হলেন না। তাঁরা বসে বসে আমাদের খাওয়া দেখলেন।