একটু অপেক্ষা করো। হোস্টেলের রান্নাঘরে গিয়ে নরেশদা কয়েকবার চিত্ত চিত্ত করে ডাকলেন। চিত্ত জবাব দিলো, যাই বাবু, অতো চিৎকার করবেন না। রাত বাজে বারোটা, এখনো রান্নাঘর ধোয়া শেষ করতে পারিনি। নরেশদা বললেন, বাবা কোনো কাজ নয়, এই তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। রান্নাঘর থেকে কালিঝুলি মাখা অবস্থায় চিত্ত আমাদের রুমে এসে বললো, আজ্ঞে বাবু বলেন। নরেশদা বললেন, বাবা কাল তিনটের মধ্যে একপোয়া সরু চাল এবং কিছু ছোটো মাছ মরিচ না দিয়ে শুধু হলুদ জিরে দিয়ে রান্না করে দিতে পারবে? একটা রোগীর জন্য। তুমি না পারলে অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখবো। তা বাবু হয়তো পারা যাবে। কিন্তু বাজারটা আমি করবো না আপনারা করবেন? সেটাও বাবা তোমাকে করতে হবে। ট্যাংরা মাছ পাওয়া যায় কিনা দেখবে। এই নাও, নরেশদা আস্ত একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট চিত্তের হাতে তুলে দিলেন। চিত্তের মুখমণ্ডলে একটা প্রফুল্লতার ছোঁয়া দেখা গেলো।
নরেশদা বললেন, ঘুমোবে? বললাম, ঘুম যে আসতে চাইছে না। চোখ বন্ধ করে থাকো, এক সময় আসবে। তিনি বাতি নিভিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরে নাক ডাকতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু আমি চোখের পাতা জোড়া লাগাতে পারছিলাম না। কোথায় একটা মস্তবড়ো গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তায়েবা, ডোরা, জাহিদুল, আমি, নরেশদা- আমাদের সকলেরই জীবন অন্যরকম ছিলো এবং অন্যরকম হতে পারতো। মাঝখানে একটা যুদ্ধ এসে সবকিছু ওলোটপালোট করে। দিয়ে গেলো। যতোই চিন্তা করতে চেষ্টা করিনে কেনো একটা সূত্রের মধ্যে বাঁধতে পারিনে। সব কিছুই এলোমেলো ছাড়া ছাড়া হয়ে যায়। এই দু-আড়াই মাস সময়, এরই মধ্যে কি রকম হয়ে গেলো আমাদের জীবন। সাতই মার্চের শেখ মুজিবের সে প্রকাণ্ড জনসভার কথা মনে পড়লো। লক্ষ লক্ষ মানুষ, কি তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা! চোখে কি দীপ্তি! কণ্ঠস্বরে কি প্রত্যয়! আন্দোলনের সে উত্তাল উত্তুঙ্গ জোয়ার, সব এখন এই কোলকাতায় রাতে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অথচ এখনো দু-আড়াই মাসও পার হয়নি! সে পঁচিশে মার্চের রাতটি, আহা সেই চৈত্র রজনী। সেই বাংলাদেশের চৈত্র মাসের তারাজ্বলা, চাঁদজ্বলা আকাশ। বাংলাদেশের জনগণের বর্ধিত আকাক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আরো প্রসারিত, আরো উদার হওয়া আকাশ। মানুষের ঘ্রাণশক্তি কি তীক্ষ্ণ! কিছু একটা ঘটবে সকলের মনের ভেতর একটি খবর রটে গেছে। দলে দলে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আপনাআপনি তৈরি হয়ে উঠছে ব্যারিকেড। জনগণের সৃজনী শক্তির সে কি প্রকাশ। রাত এগারোটা না বাজতেই রাস্তায় নামলো ট্যাঙ্ক। কামান, বন্দুক, মেশিনগানের শব্দে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। ভারী ট্যাঙ্কের ঘড় ঘড় ঘটাং ঘটাং শব্দে ঝড়ের মুখে কুটোর মতো সরে যাচ্ছে ব্যারিকেডের বাধা। সেই চৈত্র রজনীর চাঁদের আলোতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের রাজপথের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যের ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়ানো দু’জন সৈন্যের বাদামী উর্দির কথা আমি ভুলতে পারছিনে। ভুলতে পারছিনে তাদের ভাবলেশহীন মুখমণ্ডল, আর কটমটে চোখের দীপ্তি।
তারপর কি ঘটলো? তারপর? একটা ঘটনার পাশে আরেকটা ঘটনা সাজিয়ে সঙ্গতি রক্ষা করে চিন্তা করতে পারিনে। আগামীকাল কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আঁচটুকুও করতে পারিনে। তায়েবা যদি মারা যায়, কি করবো জানিনে। আমার মা, বোন, ভাইয়ের ছেলেরা বেঁচে আছে কিনা জানিনে। যেদিক থেকেই চিন্তা করিনে কে্নো, একটা বিরাট ‘না’-এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সব ব্যাপারে এতোগুলো ‘না’ নিয়ে মানুষ বাঁচে কেমন করে? সাবধানে উঠে বাতি না জ্বালিয়ে কুঁজো থেকে এক গ্লাস পানি গড়িয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। একটা ট্যাক্সি ঘটাং ঘটাং করে শিয়ালদার দিকে ছুটে গেলো। আমি সন্তর্পণে দরোজা খুলে ব্যালকনিতে চলে এলাম। কোলকাতায় একসঙ্গে আকাশ দেখা যায় না। ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে থাকা নক্ষত্ররাজি, এদের কি আমি আগে কখনো দেখিনি। ছায়াপথে ফুটে থাকা অজস্র তারকারাজির মধ্যে আমার প্রিয় এবং পরিচিত তারকারাজি কোথায়? চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
০৩-৪. ঘুম ভাঙলো দেরিতে
পরের দিন আমার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। ঘড়িতে দেখি বেলা সাড়ে দশটা বাজে। আমাদের ছেলেরা বারাসত থেকে ফিরে এসেছে। তাদের চিৎকার, কোলাহলই বলতে গেলে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। নইলে আমি আরো ঘুমোতে পারতাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সিগারেটের প্যাকেটে দেখি একটাও সিগারেট নেই। মাসুমকে বললাম, দেতো একটা। টান দিতেই আমার চোখের দৃষ্টি সতেজ হয়ে উঠলো। মাসুমকে জিগ্গেস করলাম, কখন এলে, অন্যরা কোথায়, কেমন নাটক করলে? আমার মনে হলো সে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলো। বোঝা গেলো নরেশদার সঙ্গে কথা বলে বিশেষ যুত করতে পারেনি। কারণ তিনি বরাবর ঠাণ্ডা মানুষ। হঠাৎ করে কোনো ব্যাপারে অতিরিক্ত উৎসাহ প্রকাশ করতে পারেন না। মাসুম চাঙা হয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনি থাকলে দেখতেন কি ট্রিমেন্ডাস সাকসেস হয়েছে। আমরা ক্যারেকটরের মুখ দিয়ে এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়’ এ শ্লোগান পর্যন্ত দিয়েছি। দর্শক শ্রোতারা কি পরিমাণ হাততালি দিয়েছে সে আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আমি জানতে চাইলাম, অন্যান্যরা কোথায়? মাসুম জানালো, ক্ষীতিশ আর অতীশ টিফিন করে কলেজে চলে গেছে। বিপ্লব গেছে তার বোন শিখা আর দীপাকে মামার বাসায় রেখে আসতে। সালামটা তো পেটুক। এক সঙ্গে টিফিন করার পরও ফের খাবারের লোভে একজন সিপিএম কর্মীর সঙ্গে তার বাসায় গেছে। আমি বললাম, ওরা ফিরে এসেছে, একথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেনো আপনি ওকথা বলছেন? সকলে এক সঙ্গে এসেছি, সবাই দেখেছে। বললাম, আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে বারাসতের লোকেরা সবাইকে এক সঙ্গে খুন করে মাটির নিচে পুঁতে রেখে দিয়েছে। কেন, খুন করবে কেন, আমরা কি অপরাধ করেছি। আমি জবাব দিলাম, যদি খুন না করে থাকে এবং তোমরা এক সঙ্গে নিরাপদে ফিরে এসে থাকো, তাহলে ধরে নিতে হবে সেখানকার লোকেরা তোমাদের পাগলটাগল ঠাউরে নিয়েছিলো। সেজন্য কোনো কিছু করা অনাবশ্যক বিবেচনা করেছে। মাসুম বললো, অতো সোজা নয় খুন করা। আমরা তো রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতরে নাটক করিনি। কে না জানে সেখানে কংগ্রেসের রাজত্ব। আমরা নাটক করেছি ক্যাম্প থেকে একটু দূরে। সিপিআই(এম) এর তৈরি করা স্টেজে। অথচ রিফিউজি ক্যাম্পের সমস্ত লোক নাটক দেখতে এসেছে। নাটক যখন চরম মুহূর্তটির দিকে এগুচ্ছিলো একজন সিপিএম কর্মী পরামর্শ দিলেন, দাদা এই জায়াগায় একটু প্রম্পট করে দিন এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়। তাই দিলাম। কথাটা যখন চরিত্রের মুখে উচ্চারিত হলো, সে কি তুমুল করতালি আর গোটা মাঠ ভর্তি মানুষের মধ্যে কি তীব্র উত্তেজনা! জানেন তো বারাসত হলো সিপিআইএম-এর সবচে মজবুত ঘাঁটি। কংগ্রেসের মাস্তানরা এসে কোনো উৎপাত সৃষ্টির চেষ্টা যদি করতো, তাহলে একটাও জান লিয়ে পালিয়ে যেতে পারতো না। উত্তেজনার তোড়ে পানির জগটা মুখে নিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে ফেললো। এরই মধ্যে মাসুমের উচ্চারণপদ্ধতির মধ্যে কোলকাতার লোকের মতো টানটোন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গালের বাঁ দিকটা মুছে নিয়ে সে বলতে আরম্ভ করলো, এহিয়া ইন্দিরার মধ্যে কি কোনো বেশ কম আছে। এহিয়ার সৈন্যরা সরাসরি খুন করছে। শ্রীমতি বাংলাদেশ ইস্যুটাকে নিয়ে লেজে খেলাচ্ছেন। এতে তাঁরই লাভ। বিরোধী দলগুলোকে কাবু করার এমন সুযোগ তিনি জীবনে কি আর কোনদিন পাবেন? নকশালদের তৎপরতা এখন কোথায়? এখন কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বোমা ফাটে না কেনো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার জনগণের যে জাগ্রত সহানুভূতি ইন্দিরাজী সেটাকেই নিজের এবং দলের আখের গুছাবার কাজে লাগাচ্ছেন। এতোকাল সিপিএম বলতো শাসক কংগ্রেস বাংলাদেশের মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠাবার কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করবে না। এখন সে কথা সবাই বলছে। এই তো সেদিন যুগান্তরের মতো কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকায় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সাংবাদিকও লিখতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা তুঙ্গে উঠেছে। আর ওদিকে শ্রীমতি ইউরোপ, আমেরিকায় বাবু’ ধরে বেড়াচ্ছেন। মাসুমের কোলকাতায় এসে অনেক উন্নতি হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো জিভটি অত্যন্ত ধারালো এবং পরিষ্কার হয়েছে। এখন যে কোনো সভাসমিতিতে দাঁড় করিয়ে দিলে ঝাড়া আড়াই ঘন্টা লেকচার ঝাড়তে পারে।