০১-২. হাসপাতাল এসে পৌঁছলাম
অলাতচক্র (মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস) – আহমদ ছফা
উৎসর্গ – আমার জার্মান বন্ধু পিটার জেভিৎসকে
আমি যখন হাসপাতাল এসে পৌঁছলাম, সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে। মনুমেন্টের ছায়া দীর্ঘতরো হয়ে নামছে। রবীন্দ্রসদনের এদিকটাতে মানুষজন গাড়ি ঘোড়র উৎপাত অধিক নয়। মহানগর কোলকাতা এই বিশেষ স্থানটি অপেক্ষাকৃত শান্ত নিরিবিলি। বিশেষ করে এই ক্ষণটিতে যখন গোধুলির সঙ্গে বিদ্যুতের আলোর দৃষ্টি বিনিময় হয়।
ঝাকড়া গাছগুলোর ছায়া রাস্তার ওপর বাঁকা হয়ে পড়েছে। এখানে সেখানে নগর কাকের কয়েকটি জলসা চোখে পড়লো। পরিবেশের প্রভাব বলতে হবে। বায়স কলের সমবেত কাংস্যধ্বনিও মোলায়েম কর্কশতা বর্জিত মনে হয়। ট্রাফিকের মোড়টা বায়ে রেখে পিজি হাসপাতালে ঢোকার পর মনে হলো, লাল ইটের তৈরি কমপ্লেক্স বিল্ডিং আমাকে আস্ত গিলে খাওয়ার জন্য যেনো উদ্যত হয়ে রয়েছে।
হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ারের সময় শেষ হয়ে আসছে। মানুষজন চলে যেতে শুরু করেছে। আমার কর্তব্য কি ঠিক করতে না পেরে কম্পাউণ্ডের প্রাচীর ঘেঁষা নিম গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে একটা চারমিনার জ্বালালাম। আমি একজনের খোঁজ করতে এসেছি। কিন্তু জানিনে কোন্ ওয়ার্ডে কতো নম্বর বেডে আছে। তার ওপর নতুন জায়গা এবং আমি পরিশ্রান্ত। সুতরাং সিগারেট খেয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হলো।
এই যে দাদা আগুনটা দেবেন? একজন মানুষ আমার সঙ্গে কথা বললো। গায়ে হাসপাতালের ইউনিফরম। আমার যা অবস্থা মনে হলো অকূলে কূল পেয়ে গেলাম। মানুষটা লম্বাটে, বাঁ চোখটা একটু ট্যারা। দারোয়ান হতে পারে, ওয়ার্ডবয় হতে পারে, আবার মেল নার্স হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি ম্যাচ জ্বালতে যাচ্ছিলাম। বাধা দিলো লোকটি। আহা শুধু শুধু একটা কাঠি নষ্ট করবেন কেন? দিন না সিগারেটটা। আমার হাত থেকে আধপোড়া সিগারেটটি নিয়ে লোকটি নিজের সিগারেট জ্বালালো।
ভাগ্যটা যে ফর্সা একথা মানতেই হবে। না চাইতে হাসপাতালের একজন খাস মানুষ পেয়ে যাওয়ায় মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। আমি জিগগেস করলাম, আচ্ছা দাদা, আপনি কি এই হাসপাতালের লোক? নাকে মুখে প্রচুর ধূম্ররাশি উদ্গীরণ করে জানালো, আমি চৌদ্দ নম্বর ফিমেল ওয়ার্ডে আছি। তারপর আমার দিকে একটা তেরছা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে আপাদস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে বললো, আপনি বুঝি জয়বাংলার মানুষ? আমার জবাব দেয়ার প্রয়োজন ছিলো না। কাপড়চোপড় মুখ ভর্তি দাড়ি এসব পরিচয়পত্রের কাজ করলো। লোকটা এরই মধ্যে হাতের সিগারেটটি শেষ করে একটুখানি আমার কাছে ঘেঁষে এলো। তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকলো, মশায় আজ সারাদিন কি হ্যাঙ্গামাটাই না পোহাতে হলো। তিন তিন বেটা এ্যাবসেন্ট। ডবল ডিউটি করতে হচ্ছে। দিন আপনার একখানি চারমিনার। এখুনি আবার ডাক পড়বে। এমন একটা মোক্ষম মওকা পেয়ে কৃতার্থ হয়ে গেলাম। পারলে গোটা প্যাকেটটাই দিয়ে দিতাম। আপাতত সেরকম কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়ায় একটি শলাকাতেই আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। লোকটার সিগারেট টানার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। অসন্তুষ্ট বিরক্ত শিশু যেমন মাতৃবুকে মুখ লাগিয়ে গিসগিসিয়ে টান মারে সেরকম একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হতে চায়। কপালের বলিরেখাগুলো জেগে ওঠে, চোখের মণি দুটো বেরিয়ে আসতে চায়। বোধহয় আমাকে খুশি করার জন্যই বললো, জানেন দাদা, আমাদের ওয়ার্ডে আপনাদের জয়বাংলার একটি পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে। লোকটা এপর্যন্ত দু’ দু’বার ‘জয়বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। কোলকাতা শহরের লোকদের মুখে ইদানীং জয়বাংলা শব্দটি শুনলে আমার অস্তিত্বটা কেমন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যাণ্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যাণ্ডেল। এক সপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা-ছাতা, কতো জিনিস বাজারে ছেড়েছে কোলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিছুদিন আগে যে চোখওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো, কোলকাতার মানুষ মমতাবশত তারও নামকরণ করেছিলো জয়বাংলা। এই সকল কারণে খুব দ্র অর্থেও কেউ যখন আমাকে জয়বাংলার মানুষ বলে চিহ্নিত করে অল্পস্বল্প বিব্রত না হয়ে উপায় থাকে না।
সে যাকগে। আমি জিগগেস করলাম, আপনার ওয়ার্ডে বাংলাদেশের পেশেন্টটির কি নাম জানেন নামধাম জানিনে। উনি আছেন উনত্রিশ নম্বর বেডে। বললাম, আমি এসেছি একজন রোগিনীর খোঁজে। কি অসুখ, কোথায় ভর্তি হয়েছে কিছুই বলতে পারবো না। আপনি কি এ ব্যাপারে কোনো উপকার করতে পারেন? চারমিনারের অবশিষ্ট সিগারেটগুলো তার হাতে তুলে দিলাম। লোকটি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চলুন না চৌদ্দ নম্বর ওয়ার্ডে, উনত্রিশের পেশেন্টটি যদি হয়ে যায়, তাহলে তো পেয়েই গেলেন। উনত্রিশের পেশেন্ট জয়বাংলার। অন্য কোনো পেসেন্ট থাকলে তার খবরও বলতে পারবে।