যে যাই বলুক, আমার অবস্থা এমন, শামারোখ যদি আমাকে বলত, জাহিদ, তোমাকে আমার সঙ্গে দুনিয়ার অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যেতে হবে, পাঁচতলা দালান থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ দিতে হবে, কিছুই করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ছোট্ট একটা কিন্তু সব কিছুতে বাদ সেধেছে। সেটা একটু খুলে বলি। এ পর্যন্ত শামারোখ আমাকে যে সমস্ত জায়গায় নিয়ে গিয়েছে সব জায়গাতেই আমি ভয়ংকরভাবে আহত বোধ করেছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, গ্রিন রোড, কলাবাগান এই তিনটি জায়গায় নিয়ে গেছে। ওসব জায়গায় যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, আলাদা আলাদাভাবে তাদের চেহারাগুলো চিন্তা করলেও আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসতে চায়। এইসব মানুষের সঙ্গে শামারোখের কি সম্পর্ক তাই নিয়ে আমাকে অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হয়েছে। শামায়োখের মনে কি আছে, তার অভিপ্রায় কি- একথা বার বার চিন্তা করেও আমি নিজের মধ্যে কোনো সদুত্তর পাই নি। আমি সবচেয়ে ব্যথিত বোধ করেছিলাম, যেদিন তার উপহার দেয়া জামা কাপড় পরিয়ে শামারোখ আমাকে কলাবাগানে তার বন্ধুদের আচ্ছায় সিনেমা দেখাবে বলে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে আমাকে জানতে হলো এই লোকদের একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে শামারোখ আমার জন্য শার্ট এবং সোয়েটার কিনেছে। সেদিন রাস্তার মাঝখানে ধরে তাকে পেটাতে ইচ্ছে করেছিল। হয়তো আক্ষরিক অর্থে পেটাতে না পারলেও কিছু কড়া কথা অবশ্য বলতাম এবং সম্ভব হলে শরীর থেকে সব জামা-কাপড় খুলে তার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিতাম। আবেদের মুখের ওপর বিয়ারের টিন ছুঁড়ে মারার দৃশ্যটাই আমাকে একটা দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। তারপর তো শামারোখ আমাকেই আসামি ধরে নিয়ে মস্ত বড় একখানা নালিশ ফেঁদে বসল। সে যখন বিয়ারের টিন ছুঁড়ে মারল, আমি আবেদের মুখের ওপর ঘুষি বসিয়ে দিলাম না কেন। এই মহিলাকে আমি কোনো । হিসেবের মধ্যে ফেলতে পারছি নে। মহিলা কি পাগল, নাকি অন্য কিছু?
শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গিয়ে আমাকে দেখতে হয়েছে বড় ভাইয়ের বউ তার বাহুতে কামড় দিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে। সেও নিশ্চয়ই বড় ভাইয়ের বউকে অক্ষত রাখে নি। এইরকম অব্যবস্থিত চিত্তের মহিলাকে নিয়ে আমি কি করব ভেবে ঠিক করতে পারলাম না। তাকে গ্রহণ করা অসম্ভব, আবার তাকে ছেড়ে দেয়া আরো অসম্ভব। গভীর রাতে আমি যখন নিজের মুখোমুখি হই, শামায়রাখের সমস্ত অবয়বটা আমার মানসদৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অন্তরের সমস্ত আবেগ দিয়ে ওই মহিলাকে জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষা আমার মনে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। মনে হয়, তার জন্য প্রাণ-মন সবকিছু পণ করতে পারি। কিন্তু যখন তার অন্য কাণ্ডকীর্তির কথা স্মরণে আসে, মহিলার প্রতি আমার একটা অনীহাবোধ তীব্র হয়ে জেগে ওঠে। মনের একাংশ অসাড় হয়ে যায়। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, এই আধপাগলা বিক্ষিপ্ত মানসিকতার মহিলাটির সঙ্গে আমি লেগে রয়েছি কেন? প্রতি রাতেই পণ করি, এরপর যদি শামারোখ আসে, তার চোখে চোখে তাকিয়ে বলে দেব, তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আমার সব কিছু লাটে উঠতে বসেছে। অকারণে মানুষ আমার শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। এরপর তার সঙ্গে আর মেলামেশা সম্ভব নয়।
কিন্তু পরদিন যখন শামারোখ আসে, তার চুলের রাশিতে কাঁপন ধরিয়ে আমার দিকে যখন বড় বড় চোখ দুটো মেলে তাকায়, আমার সমস্ত সংকল্প পরাজিত হয়, আমি সবকিছু ভুলে যেতে বাধ্য হই। মহিলা আমার ইচ্ছেশক্তি হরণ করে ফেলে। তারপর আমাকে দিয়ে যা ইচ্ছে করিয়ে নেয়। শামারোখকে নিয়ে এমন সংকটে পড়ে গেছি যে, সে কথা কাউকে বুঝিয়ে বলারও উপায় নেই। দুঃসহ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে দিন-রাত্রি অতিবাহিত করছি আমি। এই ডাকিনী মহিলা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?
এরই মধ্যে একদিন দুপুরবেলা শামায়োখ আমার ঘরে এল। তার আলুথালু চেহারা। চোখের কোণে কালি। পরনের শাড়ির অবস্থাও করুণ। মনে হলো সে কয়েকদিন স্নান করেনি এবং ঘুমোয় নি। এই রকম বেশে শামারোখকে আমি কোনোদিন দেখি নি। নিশ্চয়ই কোনো একটা অঘটন ঘটে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা হু হু করে উঠল। শামায়োখ তার কাঁধের থলেটা টেবিলের ওপর রেখে খাটে বসল। তার বসার ভঙ্গি দেখে আমি অনুমান করলাম শরীরের ওপর শামারোখের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই অবস্থায় কি জিজ্ঞেস করব, আমি ভেবে স্থির করতে পারলাম না। আমি কিছু বলার আগে অত্যন্ত ক্লান্ত স্বরে শামারোখ বলল, জাহিদ ভাই, এক গ্লাস পানি দেবেন? আমি পানি গড়িয়ে তার হাতে দিয়ে বললাম, আপনার কি হয়েছে, মনে হচ্ছে আপনার গোসল এবং খাওয়া কোনোটাই হয় নি। শামারোখ সমস্ত পানিটা গলার মধ্যে ঢেলে দিয়ে বলল, দুদিন ধরে আমি খেতে এবং ঘুমোতে পারছি নে। আমি বললাম, এক কাজ করুন, বাথরুমে গিয়ে আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি ডাইনিং হল থেকে খাবার নিয়ে আসি। শামারোখ বলল, খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না, আপনার কষ্ট করে লাভ নেই। আমি আপনার বিছানায় শুয়ে পড়লে আপনি কি রাগ করবেন? আমি একটুখানি আতঙ্কিত বোধ করলাম। শামারোখকে আমার বিছানায় শোয়া দেখলে অন্য বোর্ডাররা কি মনে করবে! হয়তো সবাই মিলে আমাকে এমন একটা অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে সিট রক্ষা করাটাও দায় হয়ে পড়বে। আমার আশঙ্কার কথাটা আমি শামারেখকে বুঝতে দিলাম না। আজকে ভাগ্য ভাল, হোস্টেলের বেশিরভাগ বোর্ডার টিভি রুমে ইংল্যাণ্ড এবং পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখতে গেছে। শামারোখকে বললাম, ঠিক আছে, আপনি শোবেন, তার আগে একটু চেয়ারটায় এসে বসুন, আমি নতুন চাদরটা পেতে দিই। শামারোখ মাথা নেড়ে জানালো, না, তার দরকার হবে না। বলেই সে সটান বিছানার ওপর শরীরটা ছুঁড়ে দিল। শামায়োখ বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিন। শামায়োখ না বললেও আমাকে বন্ধ করতে হতো।