উঠানটুকু পার হইবার সময় অরুণা বলিলেন,—“ওকে এক্ষুনি বেড়াতে নিয়ে যাবি কি? এসে একটুও বিশ্রাম করূল না।”
সুধী। শালের বনে বসে’ই বিশ্রাম করা হবে ‘খন।
অরুণা। বাঃ, একটু জলখাবার খেয়ে যাক্।
সুধী। তুমি ততক্ষণ তৈরি করতে থাক,—তার চেয়ে হাওয়ায়ই বেশি উপকার হবে। তুমি বরং উমাকে ডেকে নাও, বৌ-র সাহায্য আজ পাচ্ছ না! বলিয়া সুধী হাঁক ছাড়িল,—“উমি উমি!”
উমা তবুও লুকাইয়া রহিল।
০৫. বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী
বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর অবারিত অনুরাগের মাঝে একটি স্বচ্ছ অন্তরাল রচনা করিয়া তাহাকে মধুর তর করিয়া তুলিবার জন্য যে-তৃতীয়। ব্যক্তিটির আবির্ভাব শুধু বাঞ্ছনীয় নয়, প্রয়োজনীয়, সেই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে ত্যাগ করিয়া সহসা স্বামী যদি অন্তর্হিত হয়, তবে ব্যাপারটা সত্যই বিসদৃশ হইয়া উঠে। সুধী-কে পাশে না দেখিয়া প্রদীপের স্নায়বিক দৌর্বল্য উপস্থিত হইল। কিছু একটা কথা অনায়াসে বলা যাইতে পারে বটে, কিন্তু শালবীথিকে বেষ্টন করিয়া প্রশান্ত ধ্যান-গাম্ভীর্যের মত যে-সন্ধ্যা ঘনাইয়া উঠিতেছে, একটা সামান্য ও সাধারণ কথা বলিয়া তাহার তপোভঙ্গ করিবার দুঃসাহস প্রদীপের হইল না। যেমন বসিয়া ছিল তেমনই বসিয়া রহিল। অদূরে নমিতা সঙ্কোচে, ভীরুতায় একেবারে এতটুকু হইয়া গেছে। নিজের বসিবার ভঙ্গীটি হইতে সুরু করিয়া। এই অর্থহীন নিস্তব্ধতা পৰ্যন্ত তাহার কাছে অত্যন্ত বিশ্রী হইয়া উঠিল।
এমন মুস্কিলে কে কবে পড়িয়াছে! এত নিকটবর্তী হইয়া ও এমন অনুচ্চারিত পরিচয় লইয়া কাহারা মুহূর্ত গুণিয়াছে! শালের বনে সুস্নিগ্ধ সন্ধ্যায় হৃদয়ের ভাষায় আলাপ করিবার জন্য মানুষের মুখের ভাষা। যথেষ্ট সূক্ষ্ম হয় নাই কেন? ইহার চেয়ে যদি প্রদীপদের মেসের কাছে গ্যাসপোসটের সঙ্গে ধাক্কা খাইয়া একটা ছাড়া গাড়ি উল্টাইয়া পড়িত, তাহা হইলে গাড়ির মধ্য হইতে আহত সুধী ও নমিতাকে নামাইয়া তাহার ঘরের ষ্টোতে দুধ গরম করিয়া খাওয়াইয়া আলাপ জমাইতে বেগ পাইতে হইত না। কিম্বা, কল্পনা করা যাক, সুধী ও নমিতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে হাওয়া খাইতে গিয়া একটা বেঞ্চিতে। বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে, এমন সময় ছোরা-হস্তে এক গুণ্ডার আবির্ভাব হইল, অমনি পেছন হইতে যুযুৎসুর এক পাচ কসিয়া নিমেষে প্রদীপ ব্যাপারটাকে ইন্দ্রজালের চেয়েও রোমাঞ্চময় করিয়া তুলিল—এমন সাহসিক কীর্তি যে সে দুই একটা করে নাই তাহা নয়। তাহা হইলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আলাপ করিবার ভার পড়িত নমিতারই উপর (ধরা যাক সুধী উপস্থিত ছিল না ), প্রদীপকে তাহা হইলে এমন ঘামিতে হইত না। কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটিলে আলাপটা কথা না কওয়ার মতই সহজ হইয়া উঠিত। এই সময় শুক্ননা পাতার ভিড় সরাইয়া একটা সাপ আসিয়া দেখা দিলেও অসঙ্গত হইত না—হিংস্র সাপ অনায়াসে কবিতার বিষয়ীভূত হইতে পারিত। কথা কহিতে পারিবে না, অথচ এই অতলস্পর্শ স্তব্ধতায় আত্মার গভীরতম পরিচয় গ্রহণ করিতে হইবে, মানুষের ভাষাকে বিধাতা এত অসম্পূর্ণ ও নিস্তেজ করিয়াছেন কেন? যাহা প্রত্যক্ষ তাহাই ত জ্ঞানের একমাত্র মূল নয়; কিন্তু যাহা প্রকাশের অতীত হইয়াও অনুভবের অগোচর নয়, সেই চেতনাকে নমিতার প্রাণে সঞ্চারিত করিয়া দিবার উপায় কোথায়? এই নীরব আকাশকে ব্যঙ্গ না করিয়া সন্ধ্যার সঙ্গে অকৃত্রিম সঙ্গতি রাখিয়া এই হৃদয়চাঞ্চল্যটিকে প্রকাশিত করিবার অমিতশক্তি বাঙলা-ভাষা কবে লাভ করিবে?
সুখনিদ্রার মত অন্ধকার গাঢ় হইয়া উঠিতেছে, অথচ সুধীর ফিরিবার নাম নাই। অবশেষে প্রদীপের মুখে অজ্ঞাতসারে ভাষা আসিল : “আর বসে কাজ নেই, চল।” এবং এই একটি মাত্র আহ্বানে নমিতা উঠিয়া পড়িল দেখিয়া, প্রদীপের খেয়াল হইল যে সে কথা বলিতে পারিয়াছে। এবং একবার যখন ব্যুহদ্বারের বিপুল বাধা পরাভূত হইয়াছে, তখন প্রদীপকে আর পায় কে? মাঠটুকু পার হইয়া রাস্তায় নামিয়াই প্রদীপের রসনায় ভাষা অনর্গল হইয়া উঠিল : “দেখ, আমাদের দেশে মেয়ে-পুরুষে সহজ পরিচয়ের বাধা বিস্তর, কিছুতেই আমরা সামঞ্জস্য রাখতে পারি না। তোমরা আমাদের কর সন্দেহ, আমরা তোমাদের করি অশ্রদ্ধা। তাই আমরা মধুর সখ্যের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে, আত্মাকে খৰ্ব্ব ও কর্মশক্তিকে পঙ্গু করে’ রেখেছি। আমরা কিছুতেই সহজ হতে পারি না—সে আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য সাধনা। জড়িমার আবরণ রচনা করে আমরা আত্মরক্ষা করি —তোমরা হও সতী, আমরা হই সাধু। কিন্তু তা যে কত অসার, তার মূল্য যে কত অল্প, তা আমরা বুঝি যখন একে-অন্যের বন্ধুতায় নতুন করে আবার আমরা আবিষ্কৃত হই, যখন আমাদের জীবন প্রসারিত আয়তন লাভ করে।—দেখো, হোঁচট খেয়ে না—”
এই সব কথার উত্তর দিতে হইলে বড়-বড়ো কথা না কহিলে বেমানান হইবে, তাহার জন্য নমিতা এখনো প্রস্তুত হয় নাই; তাই হোঁচট খাইবার কথায় সামান্য একটু হাসিয়া নমিতা চুপ করিয়া রহিল। প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিল,—“সুধী হঠাৎ আমাকে ডেকেছে কেন বলতে পারো?”
নমিতা কহিল,—“কাশ্মীর বেড়াতে যাবেন, আপনি সঙ্গী হবেন তার।”
প্রদীপ। কাশ্মীর? হঠাৎ? পৃথিবীতে এত লোক থাকতে কাশ্মীরের শীত সইতে আমি তার সঙ্গী হ’ব, আমার অপরাধ?
নমিতা। জানি না, কিন্তু তার অপরাধ আরো গুরুতর। আমাকে সঙ্গে নেবেন না। বলুন তো এটা তার অত্যাচার নয়?