প্রদীপ। বলিস কি? এমন সুন্দর মেয়েটি থামিয়া গেল )
সুধী। হ্যাঁ জানি, কিন্তু পরখ করে দেখলাম নারী-মাংস আমার রুচবে না। গার্হস্থ্য-ধৰ্ম্ম পালন করবার মত আমার মনের সেই প্রশান্তি বা প্রশস্ততা কিছুই নেই। আমি জীবনে যে ভুল করে বসেছি, তার থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে তোর সাহায্যের দরকার হয়েছে।
প্রদীপ। যথা?
সুধী। নমিতাকে জাগিয়ে দিতে হবে। ও আমাকে ভয় বা ভক্তি করতে পাবে বটে, কিন্তু ভালোবাসতে পারূবে না; কারণ, আমাকে কোনো দিন হারাবে বলে’ ওর মনে না থাকবে সন্দেহ না-বা আশঙ্কা। ও জল হয়ে চিরকাল আমার গ্লাশের রঙ ধরে থাকবে। ওর মধ্যে স্থিরতা থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণ নেই। যার প্রাণ নেই সে কুৎসিত।
প্রদীপ। অন্ধকারে ঘরে বসে থেকে সব ঝাপসা দেখছি। চল বেরোই।
সুধী। বাইরেও অন্ধকার বটে, কিন্তু মুক্তি আছে, বিস্তৃতি আছে। নমিতাকে তোর মানুষ করে দিতে হবে; ওর আত্মার অবগুণ্ঠন যদি ছিড়ে ফেলতে পারি ভাই, তবেই হবে ওর পুনর্জীবন!
প্রদীপ। তুই তা হলে কি করূতে আছিস, গৰ্দত?
সুধী। ওর শরীরের ওপর পাহারা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করবার নেই। তোর সঙ্গে নমিতার সম্পর্কে-ই একটা বন্ধনহীন ক্ষেত্র আছে, তোর কাছে ও নবীন, মধুররূপে অনাত্মীয়, সেইখানেই তোদের পরিচয় ঘটুক। তোর মাঝে নমিতাকে আমি পুনরাবিষ্কার করতে চাই।
প্রদীপ। এই সাত মাসেই এত সব সিদ্ধান্ত হয়ে গেল?
সুধী। রমণীর মন লক্ষ বর্ষ ধরে’ও আয়ত্ত করা যায় না, উনবিংশ শতাব্দীর এই সেন্টিমেন্টাল উক্তি আমি বিশ্বাস করি না। তাতে শুধু আয়ুরই বৃথা অপচয় ঘটে। আমার হাতে অত সময় নেই।
প্রদীপ। (হাসিয়া) আর আমারই আছে? এর জন্যে তুই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিস? ভেবেছিলাম কারু অসুখ হ’ল বুঝি। আমাকে তোর ভীষণ দরকারের এই যদি নমুনা হয়, দে, সুটকেশটা এগিয়ে দে, চললাম ফিরে’। ফমাসে কবিতা এলেও বন্ধুতা আসে না।
এই সময় বেড়াইতে যাইবার পোষাকে অবনীনাথ সেই ঘরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ঘরে অপরিচিত লোক দেখিয়া কিছু জিজ্ঞাসা করিবার জন্য তিনি একটু ইতস্তত করিতেছেন, সুধী আগাইয়া আসিয়া কহিল,—“এ আমার বন্ধু, প্রদীপেন্দ্র বসু—ভারতের ভাবী ‘ডেলিভারার।”
অবনীনাথ বিস্মিত হইবার আগেই প্রদীপ বলিল,—“তার মানে?”
সুধী। ( অবনীনাথের প্রতি) ইনি এক চড় মেরে এক গুণ্ডাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন!
অবনীনাথ। তাই নাকি? দেখি, আমার সঙ্গে পাঞ্জা ধর ত’! ( শিশুর মত সরলবশ্বাসে হাত প্রসারিত করিয়া দিলেন।
প্রদীপ। (সঙ্কুচিত হইয়া) গুণ্ডা ঠেঙিয়ে আমি যদি ভারতের কনিষ্ঠ ডেলিভারার হই তা হলে দু’ পাতা গল্প লিখে সুধী নিশ্চয়ই ভলটেয়ার হয়েছে।
প্রসন্নহাস্যে মুখ উদ্ভাসিত করিয়া অবনীনাথ কহিলেন,—“কয়েক দিন আছ ত’?”
প্রদীপের মুখ হইতে কথা কাড়িয়া নিয়া সুধী বলিল,-“নিশ্চয়ই।”
তাহার পর বন্ধুকে লইয়া সুধী একেবারে রান্নাঘরে আসিয়া হাজির,–সেখানে তাহার মা বঁটি পাতিয়া তরকারি কুটিতেছিলেন। সুধী হাঁকিল,—“তোমার জন্যে আরেকটি ছেলে কুড়িয়ে আনলাম, মা। আরেকটি বাতি জ্বলল।”
প্রদীপ প্রণাম করিতেই অরুণা কহিলেন,—“তোমার কথা অনেক শুনেছি আগে, সুখী-র সঙ্গে তোমার অনেক দিনের চেনা; অথচ আগে দেখিনি। ওর বিয়ের সময় ত’ রাগ করেই এলে না।”
প্রদীপ অল্প-একটু হাসিল, কহিল,সুধী-ও বিয়ে করে বয়ে যাবে এ-আঘাতের জন্যে তৈরি ছিলাম না। নিয়তিকে আমবা খণ্ডিত কবুব এই ছিল আমাদের পণ। দেখলাম পণের টাকা মিললে নিয়তি যথারীতি কাঁধে চড়াও হয়।”
সুধী নমিতার খোঁজে তাহার শুইবার ঘরে আসিয়া উঠিল। দেখিল, নমিতা তাহার বেড়াইবার দামী কাপড়-চোপড়গুলি ছাড়িয়া সাদাসিধা একখানি আটপৌঁরে শাড়ি পরিয়াছে। সুধী কহিল,—“হঠাৎ এ বেশ? আমার বন্ধুকে দেখে এক নিমেষেই তপস্বিনী সেজে গেলে নাকি?”
নমিতা। বন্ধু এসেছেন; এখন বেড়াতে যাবে কি? যাও!
সুধী। বাঃ, বন্ধু এসেছে বলেই মাঠে যাওয়া বন্ধ করে আমাকে এমন সন্ধ্যাটা মাঠে মারূতে হবে নাকি? দাঁড়াও, ডাকি প্রদীপকে।
নমিতা। ( বাধা দিয়া) দরকার নেই আজ গিয়ে। অমি যাবো না কখনো।
সুধী। কেন? আমার বন্ধুকে তোমার কিসের ভয়? তোমাকে ভয় দেখাতে ও বন্দুক নিয়ে আসেনি, যদিও তোমাকে জয় করতে দুই চক্ষুর দৃষ্টিই ওর যথেষ্ট।
নমিতা মনে মনে স্বামীর উপর নিদারুণ চটিতেছে, এমন সময় সুধী-র ডাকাডাকিতে প্রদীপ সেই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল।
সুধী। (নমিতাকে দেখাইয়া) দেখলে?
প্রদীপ। বেশ ত, নিরাভরণেই শ্ৰী। তারা ফোটার আগেকার স্নিগ্ধ গোধূলি-আকাশটুকুর মতই তোমাকে দেখাচ্ছে, বৌদি।
সুধী। এই যাঃ, মাটি করে দিলে! প্রদীপ। তার মানে?
সুধী। ঐ ‘বৌদি’-কথাটা এসে এমন সুন্দর উপমাটাকে একেবারে বধ করলো। কর্ণ, বধির হও! ( নমিতাকে) তুমিও যদি এবার কৃপা করে’ ওকে ঠাকুরপো বলে ডাক, তবেই কলির পাপ চারপোয়া পূর্ণ হয়ে ওঠে।
হাসিয়া নমিতা অন্তর্হিত হইল বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দ্বারান্তরালে তাহার যখন পুনরাবির্ভাব হইল, দেখা গেল, উমার ঘর হইতে সে আরেকখানা শাড়ি পরিয়া আসিয়াছে। না সাজিলে তাহার লজ্জা যেন ঘুচিবে না। আড়ষ্ট হইতে না পারিলে তাহার এই অপরিচয়ের দৈন্য তাহাকে কেবলই পীড়া দিতে থাকিবে। ভাবের অভাব ঘটিলেই ভাষায় বর্ণবাহুল্যের প্রয়োজন ঘটে—নমিতা সেই ভাববিরহিত অলঙ্কত ভাষা, মূক, নিরর্থক!