সুধী বেশি কিছু লিখে নাই; শুধু দু’টি কথা: যত শিগগির পার চলে এস। তোমাকে আমার ভীষণ দরকার।
সাত মাসে নদী শুকাইয়া যে চর জাগিতেছিল, তাহাকে কখন এবং কি করিয়া যে অজস্র জোয়ার আসিয়া ভাসাইয়া দিয়া গেল, তাহা সত্যই বুঝা গেল না। প্রদীপ তখুনি তাহার ছেড়া সুটকেসটা নিয়া ম্যানেজারের ভাতের থালায় লাথি মারিয়া ষ্টেশনের মুখে বাহির হইয়া গেল।
সুধী-দের বাড়িতে যখন আসিয়া পৌঁছিল, তখনো বিকালের আলোটুকু আকাশের গায়ে লাগিয়া রহিয়াছে। দুয়ারের কাছেই উমার সঙ্গে প্রথম দেখা। প্রদীপ সরাসরি জিজ্ঞাসা করিল,—“সুধী কোথায়?” উমা ভড়কাইয়া গিয়া কি বলিবে কিছু ভাবিতে না ভাবিতেই, প্রদীপ প্রায় উমার গা ঘেঁসিয়া তাড়াতাড়ি যে-ঘরটাতে আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহারই এক কোণে দরজার দিকে পিছন করিয়া সুধী তখনো টেবিলের উপর মুখ গুঁজিয়া তন্ময় হইয়া বই পড়িতেছে। হঠাৎ প্রদীপ তাহার দ্রুত পদবিক্ষেপগুলিকে সংযত করিয়া লইল। অতি ধীরে নিঃশব্দপদে সুধী-র পিছনে আসিয়া দুই হাত দিয়া তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল। অল্প একটু মুখ তুলিয়া সুধী কহিল,—“এই উঠছি নমিতা, এখনো ঢের আলো আছে। বেশ অন্ধকার করে না এলে শালমৰ্ম্মরের সঙ্গে মানুষের প্রেমগুঞ্জনের সঙ্গতি হয় না। ছাড়, দেখি কেমন সেজে এলে।”
চক্ষু হইতে হাত দুইটা সরাইয়া সুধীর কর্ণমূলে স্থাপন করিয়া প্রদীপ কহিল,-“এই তুই পাণিগ্রহণ করেছিস! মূখ। এখনো হাত চিনিস নি?”
সুধী চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিল। আনন্দদীপ্ত কণ্ঠে কহিল, “তুই এই অসময়ে এসে পড়লি? কখন চিঠি পেয়েছিস?”
“অসময়ে এসে পড়েছি বলে’ এই গণ্ডারের চামড়ার হাতকে তুই এমন অসম্মান কবি? বিয়ে করে তুই কাণা হয়ে গেলি নাকি?”
“দাঁড়া।” বলিয়া সুধী ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল এবং মুহুৰ্তমধ্যে যাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল, তাহাকে দেখিয়া প্রদীপ এতটা অভিভূত হইল যে, মানুষের ভাষায় তাহার ব্যাখ্যা হয় না। সৃষ্টির প্রারম্ভে একাকী আকাশের তলায় দাঁড়াইয়া নিঃসঙ্গ প্রদীপ এমনি করিয়াই অভিভূত হইত হয়ত। একদিন পুরী-ষ্টেশন হইতে গরুর গাড়ি করিয়া বাহির হইয়া সমুদ্রের খোঁজে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, গাছ আর বৃক্ষান্তরালে আকাশের টুকরো; সহসা এক সময়ে দেখিল সমস্ত গাছ সরিয়া গেছে, দৃষ্টিকে অপরিসীম মুক্তি দিবার জন্য আকাশ শূন্যে বিলীন হইয়া গেছে—সম্মুখে ফেনফণাময় মহাসমুদ্র! সেদিন প্রদীপ এমনিই অভিভূত হইয়াছিল। বিকালবেলা স্বামীর সঙ্গে শালবীথিতলে কয়েকটি নিভৃত মুহূর্ত যাপন করিবার জন্য নমিতা সাজিয়া আসিয়াছে, সেই দেহসজ্জায় কীই-বা ছিল আর! প্রদীপ রূপ দেখিল না, দেখিল বিভা—প্রতিভামণ্ডিত ললাটে ব্রীড়ার স্নিগ্ধতা, বুদ্ধিবিকশিত চোখে কুণ্ঠার মাধুৰ্য্য! নমিতা যেন শরীরী আত্মা, যেন শেলির মূর্তিমতী কবিস্বপ্ন! প্রদীপ এমন পাগল যে, হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া তৃপ্ত হইবে না বলিয়া, নীচু হইয়া নমিতার পা স্পর্শ করিয়া বসিল।
সুধী বলিল,-“তুই যে দেবর লক্ষ্মণের মতো মুখ ছেড়ে পা-কেই বেশি মর্যাদা দিচ্ছিস?”
নমিতা লজ্জায় চক্ষু নামাইয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল, আর, এমন একটা মুহূর্তে কেহ এমন একটা বাজে রসিকতা করিতে পারে ভাবিয়া প্রদীপের আর কথা বলিতে ইচ্ছা হইল না।
সুধী নমিতাকে কহিল,—“তুমি নিশ্চয়ই এ কে, বুঝতে পেরেছ। আমাদের উপন্যাসের নায়কের মাথাটাকে যে ভাগ্যের পায়ের ফুটবল বানিয়েছে। ভালো করে চেয়ে দেখ। ঘরে অতিথি এসেছেন, আৰ্যপুত্রের কুশল প্রশ্ন কর। তুমি সীতা-সাবিত্রীর মাসতুতো বোন হ’য়ে অমন ঘাবড়ে গিয়ে ঘাড় গুজে থাকলে চলবে কেন?”
প্রদীপ কহিল,—“একলা তোমার সম্বর্ধনাই যথেষ্ট হয়েছে। বৌদির নীরব সহানুভূতিটির মূল্য তার চেয়ে কম নয়।”
সুধী। (নমিতার প্রতি) মুখে ও তা’ বলছে বটে, কিন্তু অমন শ্রীমুখের কথা না শুনে ওর পেট নিশ্চয়ই ভরূবে না। তুমি যাদ আজ আকাশের তারাগুলোর যোগাযোগে প্রদীপের দীপধারিণী হতে, তা হ’লে আমি তোমার ঐ বোব মুখের ওপর অত্যাচার করে কথা ফোটাতাম।
নমিতা সুধী-র কনুইয়ে চিমটি কাটিয়া দিল।
সুধী। এ চিমটি তুমি প্রদীপকেও উপহার দিলে বেমানান হত। কেননা সাত মাস আগে তোমার উপর ওর দাবি আমারই সমান। ছিল। তোমার গায়ের গয়না যথেষ্ট নয় দেখে, আমি যদি বিয়ে-সতা থেকে সরোষে গাত্রোখান করতাম, আর প্রদীপ যদি সেই পরিত্যক্ত পিঁড়িতে এসে বস্ত, তা হলে তোমার আজকের এই রমণীয় কুণ্ঠাটি আমারই একান্ত উপভোগ্য হ’ত। ও তোমাকে প্রণাম কবুল, আর তুমি ওকে সামান্য একটু চিমটি কাটবে না?
নমিতার পক্ষে ই দাঁড়াইয়া সহ্য করা অস্বাভাবিকরূপে কঠিন হইয়া দাঁড়াইল। স্বল্প একটু ‘যাও’ বলিয়া নমিতা অন্তর্হিত হইলে প্রদীপ বলিল,—“এ তোমার বাড়াবাড়ি সুধী!”
সুধী। বাড়াবাড়ি মানে? নমিতাকে পাবার জন্যে কী মূল্য দিয়েছি? সমাজকে মেনে নিয়ে ওর দেহের ওপর একচ্ছত্র রাজত্ব করছি বটে, কিন্তু ওর মনকে আমারই মুঠির মধ্যে চেপে ধরে মলিন করে দেব, আমি সে-বর্বরতা সহ্য করতে পারবো না। ওর লজ্জা তোমাকে জোর করে’ ভেঙে দিতে হবে।
প্রদীপ। ওর লজ্জা ভাঙতে গিয়ে তোমারো মন যদি ভেঙে যায়?
সুধী। ( দৃপ্ত-স্বরে) ভাঙুক! এই ঠুনকো মন নিয়ে আমি বাঁচতে চাই নে।
প্রদীপ। তোকে পাগলা কুকুরে কামড়ালে কবে?
সুধী। ঠাট্টা নয়; নমিতাকে আমার ভালো লাগে নি, লাগবেও না।