ধীরে ধীরে প্রদীপের মাথাটা বালিশের উপর নামাইয়া রাখিয়া নমিতা উঠিয়া পড়িল। দক্ষিণের জানালাটা খুলিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। রাত্রি অনেক হইয়াছে—আকাশে মেঘ কাটিয়া বিবর্ণ ঘোলাটে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে। ভোর হইয়াছে ভাবিয়া কয়েকটা কাক এখানে-সেখানে চীৎকার করিতেছিল। নদীতে দু’ একটি নৌকাও দেখা যায়। কোথায় একটি বাতি জ্বলিতেছে-না-জানি কত দূরে!
ঘাটে যেখানে নৌকার যাত্রী লইয়া দূর ষ্টিমার-ষ্টেশনে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য সৰ্ব্বদা গাদি করিয়া থাকে সেই ঘাটের পথ সে চিনিতে পারিবে ত’? এই রাত্রে নিশ্চয়ই কেহ নৌকা ছাড়িবে না, উত্তরপশ্চিম কোণে এখনো মেঘ আছে। হয় ত’ উহারই বিপদের আশঙ্কায় নৌকা ছাড়িবে না। নমিতার জীবনে আবার বিপদ কিসের? তরঙ্গ-সন্ধুল ফেনোচ্ছসিত নদী যে তাহার বন্ধু, সহযাত্ৰিনী। বিধাতা, আজিকার এই অভিসারে যেন অজয়ের সঙ্গে তাহার দেখা না হয়। সে যেন একাই চলিতে পারে, একাই মরিতে পারে যেন। এই গৰ্বটুকু তাহার নষ্ট করিয়ো না।
এখান হইতে তার পাশা—তার পরে ষ্টিমারে গোয়ালন্দ। সেখানে ট্রেন দাঁড়াইয়া আছে। তার পর কলিকাতা। তার পর? এখানে বসিয়া থাকিলেও, তার পর? ক্ষণকালবিহারী মানুষের চিত্তে ইহার সমাধান কোথায়!
একেবারে একা—সঙ্গীহীন। সম্মুখে পথ—মুহূৰ্ত্ত হইতে মহাকালে। নমিতা একবার ফিরিয়া দাঁড়াইল। যাইবার সময় ঐ ঘুমন্ত অসহায় প্রদীপের চেহারা দেখিয়া তাহার মমতার আর অন্ত রহিল না। একবার সাধ হইল নিজে ইচ্ছা করিয়া প্রদীপের কপালে অস্ফুট একটি বিদায়-চুম্বন উপহার দিয়া আসে; গভীর শব্দহীনতায় গোপনে বলিয়া আসে : এই চুম্বনে তোমার ললাট দগ্ধ করে যাই, বন্ধু। আমাদেরই মত তুমি ব্যর্থ হও, ধন্য হও।
কিন্তু না, যদি জাগিয়া উঠে! যদি দুই ব্যাকুল বাহু-বন্ধনে তাহাকে বন্দী করিয়া রাখিতে চায়! যদি এই অবসন্ন জ্যোৎস্নাটুকুর মতই তাহার সকল সঙ্কল্প স্তিমিত হইয়া আসে!
নমিতা বাহির হইয়া আসিল।
সমস্ত পাড়া নিঝুম। মাঠে জল জমিয়াছে। সেই জল ভাঙিয়া নমিতা অগ্রসর হইল। পথ সে ভাল করিয়া চিনে না, কিন্তু পথ তাহাকে খুঁজিয়া লইতে হইবে। এক পথ হইতে অন্য পথে, এক দিনের পর অন্য রাত্রে। থামিবার সময় কোথায়?
কিছুদূর অগ্রসর হইতেই দূরে কাহাকে যেন দেখা গেল। কে যেন তাহাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে। নমিতা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। লোকটা তবু তাহাকে সঙ্কেত করিতেছে। তাহারই সম্মুখীন না হইয়া নমিতা আর যায় কোথায়?
আরো খানিকটা কাছে আসিতেই লোকটাকে চিনিতে পারিয়া নমিতার সর্বদেহ ভয়ে ও উত্তেজনায় কাঁপিয়া উঠিল। এ যে তাহার স্বামী–সুধী! রাণীগঞ্জে শালবনে সেইদিন যে-পোষাকে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলেন পরনে সেই পোষাক। মুখে সেই অম্লান হাসিটি; তেমন করিয়া বাঁ হাতে কোঁচাটা তুলিয়া ধরিয়াছেন।
যেন সেই মূর্তি তাহাকে বলিল : “এস আমার সঙ্গে।”
আর একটু আগাইয়া হাত বাড়াইয়া দিলেই যেন নমিতা সে-মূর্তিকে ধরিয়া ফেলিবে। নমিতা ত্বরিত পদে পথ চলিতে লাগিল, কিন্তু তবুও তাহার নাগাল পাইল না।
নমিতা চীৎকার করিয়া উঠিল : “কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছ?”
সে-মূর্তির কণ্ঠ হইতে স্পষ্ট উত্তর আসিল: “এস আমার সঙ্গে। তোমার কিচ্ছু ভয় নেই।”