—“না, পুরুষমানুষের খিদে না পেয়ে পারে? আমার কথা শুনে ত’ আপনার পেট ভরবে না।”
—“সত্যি বলছি, আমার খিদে নেই। কাল খুব ভোরে উঠে না-হয় দুটি বেঁধে দিয়ে।”
—“বেধে আমি এখনই দিচ্ছি। একটিবার মথুবকে ডেকে দিন্ না।“
—“তুমি বাঁধতে গেলেই আমি আলো খাব না। এই আমি শুয়ে পড়লাম।” বলিয়াই প্রদীপ নমিতার নিজের জন্য পাতা বিছানাটার উপর শুইয়া পড়িল : “তোমার বিছানায় শুলাম, নমিতা।”
নমিতা ধীরে কহিল,—“বেশ ত। ঐ, জালাটা খুলে গেল। শিগগির বন্ধ কবে দিন। নইলে এক্ষুনি ভীষণ ঠাণ্ডা লেগে যাবে। একেই ত’ আপনার শরীরটা ভালো নেই—”
জাল্লাটা বন্ধ করিয়া প্রদীপ আবার বিছানায় শুইয়া পড়িল। নিতান্ত ছেলেমানুষের মত আবদারের সুরে কহিল,—“কাল থেকেই মাথাটা কেমন ধরে’ আছে, নমিতা”
নমিতা শুধু কহিল,—“যাচ্ছি। আমার এই হ’ল বলে।”
প্রদীপ অসাড় হইয়া চক্ষু বুজিয়া পড়িয়া রহিল। কতক্ষণ পরে নমিতা শিয়রের কাছে আসিয়া স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কহিল,—“বালিশের ওপর মাথাটা ভালো করে রাখুন। কোনখানটায় ধরেছে?” বলিয়া সে প্রদীপের শিয়র ঘেঁসিয়া পা গুটাইয়া বসিল। প্রদীপ একবার ভালো করিয়া নমিতার মুখ দেখিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সে আগেই লণ্ঠনটা নিবাইয়া দিয়াছে। অন্ধকারে সেই মুখের বিন্দুমাত্র আভাস পাওয়া গেল না।
নমিতা প্রদীপের কপালের উপর স্নিগ্ধ আঙুলগুলি ধীরে বুলাইতে বুলাইতে কহিল,—“কপালটা টিপে দিই, কেমন? একটু ঘুমুবার চেষ্টা করুন। এ কয়দিন ত’ শরীরের ওপর আর কম অত্যাচার হয় নি।”
প্রদীপ কহিল,—“আমি ঘুমিয়ে পড়ব কি! আর তুমি?”
–“পরে আমিও না হয় ঘুমিয়ে পড়ব। এমন বৃষ্টিতে শরীর ভেঙে ঘুম নেমে আসবে।”
—“তুমি এখানে শোও; আমি আমার বিছানায় যাই।”
নমিতা প্রদীপের ললাটের উপর করতলটি বিস্তৃত করিয়া স্থাপন করিয়া কহিল,—“এখানে একা শুতে আমার ভয় করবে যে।”
কপালের উপর নমিতার ঠাণ্ডা হাতখানি মুঠির মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া। প্রদীপ কহিল,—“তবে?”
প্রদীপের করতলের মধ্যে নিজের ভীরু হাতখানি ছাড়িয়া দিয়া নমিতা বলিল,-“তবে আর কি? ঘুম পেলে কখন একসময় আপনারই পাশে শুয়ে পড়বে না হয়।”
—“আমার পাশে?”
—“হ্যাঁ, আপনাকে আমি ভয় করি নাকি?” নমিতার কথার সুরে একটুও রুক্ষতা নাই,ভারি কোমল, আর্দ্র কণ্ঠস্বর!
এই ভাবে বসিবার সুবিধা হইতেছিল না; নমিতা বিছানার উপর পা তুলিয়া ঠিক করিয়া বসিতে না বসিতেই প্রদীপ বালিশটা তাড়াতাড়ি ঠেলিয়া দিয়া তাহার বিস্তৃত কোলের উপর মাথাটা তুলিয়া দিল। নমিতা কিন্তু মাথাটা নামাইয়া রাখিল না। স্নেহ-আনত দুইটি আয়ত চক্ষু প্রদীপের মুখের উপর নিবদ্ধ করিয়া অকুণ্ঠিত আবেগে তাহার কপালে ও গালে হাত বুলাইতে লাগিল।
প্রদীপ কহিল,-“তোমার প্রতি অনেক দুর্ব্যবহার করেছি, নমিতা—”
জোরে একটু হাসিয়া নমিতা বলিল,-“তার শাস্তিই ত’ এখন পাচ্ছেন।”
প্রদীপ নমিতার একখানি হাত ধরিয়া ফেলিয়া একেবারে বুকের মধ্যে গুঁজিয়া ফেলিল; কহিল,-“বিধাতা সবারই জন্যে সমান পথ তৈরি করে রাখেন নি–”
নমিতা কহিল,—“কারুর জন্যেই পথ তিনি তৈরি করে রাখেন না। পথ সৃষ্টি করবার গৌরবও যদি আমাদের না থাকে তবে চল্বার আমাদের আর আনন্দ কোথায়?”
—“আমার জন্যে এই ভুবন-ভরা খাতুর উৎসব—”।
–“আর কারুর জন্যে বা ঘন-গহন অন্ধকার!”
—“আমার জন্যে তোমার প্রেম, এই যৌবন, এই অগ্নিশিখা।” বলিয়া মুহমান প্রদীপ সহসা নমিতাকে বুকের মধ্যে আকর্ষণ করিয়া তাহার চিবুকে অধরে চোখের পাতায় চোখের নীচে অজস্র চুম্বন করিতে লাগিল।
প্রতিরোধ করিবার সমস্ত শক্তি নমিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। সে যে নিষ্প্রাণ একটা দেহপিণ্ড! ঝড়ের রাত্রে সে যেন অসহায় পৃথিবী!
বুকের উপর নমিতার আলুলিত রুক্ষ চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে প্রদীপ কহিল,—“যে যা বলে বলুক নমিতা, আমরা ধূলির ধরণীতে স্বর্গ আবিষ্কার করব—আমাদের প্রেমে, সহকর্মিতায়। আমি কবি, তুমি আমার আকারময়ী কল্পনা! নমিতা!”
নমিতা তাড়াতাড়ি মুখ তুলিয়া কহিল,—“সারা রাত ভরেও কথা কয়ে শেষ করতে পারবেন না। শেষই যেন তার না থাকে। এই কথা আপনার অক্ষরে ফুটে উঠুক। আনন্দের কথা সন্ধ্যার বর্ণচ্ছটার মত মিলিয়ে যায়, কিন্তু ব্যর্থতার কথা রাত্রির অন্ধকারে তারা হয়ে অক্ষয় অক্ষরে জেগে থাকে!”
প্ৰদীপ নমিতার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বিস্রস্ত অবগুণ্ঠনের নীচে সে-মুখোনিতে অসীম বেদনার মেঘছায়া মাখিয়া রহিয়াছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল।
নমিতা বলিল,—“মনটাকে খানিকক্ষণ একেবারে কঁকা রাখুন, আপনিই ঘুম এসে যাবে। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আপনি না ঘুমুলে আমি কি করে শুই।”
প্রদীপ কহিল,—“তুমি কি আমাকে একবারো তুমি বলবে না?”
কিছু কাল স্তব্ধ থাকিয়া হঠাৎ নমিতা নত হইয়া মুখটা প্রদীপের কানের কাছে নিয়া গিয়া অতি গাঢ়কণ্ঠে ডাকিল : “তুমি, তুমি, তুমি!”
—“এবার যদি আমি মতামও নমিতা, আমার দুঃখ থাকতো না।”
নমিতা বলিল, “নিশ্চয়। তোমার জন্যে এই অলস আবেগময় মৃত্যু, কারুর জন্যে বা কন্টকত কদৰ্য জীবন। প্রেমহীন আশ্বাসহীন কঠোর মুহূর্ত। কিন্তু, আর নয়, এবার ঘুমুও।”
প্রদীপ নিঃশব্দে নমিতারই কোলের উপর মাথাটা কাৎ করিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
এক সময়ে স্পষ্ট বুঝিল নমিতা আর হাত বুলাইতেছে না—স্তব্ধ। হইয়া পাষাণ-প্রতিমার নিশ্চল অটুট ভঙ্গিতে বসিয়া আছে। তার পর নমিতা যে আর কী করিল বোঝা গেল না। প্রদীপ ততক্ষণে গাঢ় নিদ্রায় ঢলিয়া পড়িয়াছে।