—“প্লেট-ফ্লেট লাগবে না। এই দাও।” বলিয়া অন্ধকারে খাবার গুলি ভাল করিয়া ঠাহর না করিয়াই অজয় গোগ্রাসে গিলিতে সুরু করিল। ভাল করিয়া চিবাইবারো সময় হইল না; একমুখ খাবার লইয়া কহিল,-“দু’ দিন পেটে কিছু যায় নি একদম্। নেহাৎ ভাগ্য প্রসন্ন বলেই প্রসাদ মিললো। জল? জল লাগবে না—এক্ষুনি যেতে হবে আমাকে। দাঁড়াবার আর এক ফোটাও সময় নেই। মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁ করে’ ছুটলেই জল পাওয়া যাবে। তার ওপর এখন যদি নদী সন্ত্রাতে হয়, তা হলে ত’ কথাই নেই—”
নমিতা বাধা দিয়া কহিল,—“এখুনি যাবেন কি? দাঁড়ান, জল আনতে কতক্ষণ? সব সময়েই দুরন্তপনা করতে নেই।”
কথার সুরটা অজয়ের কানে কেমন একটু অদ্ভুত ঠেকিল,—যাইতে সত্যই পারিল না। নমিতা জল নিয়া আসিল। এক টোকে সবটা নিঃশেষ করিয়া অজয় কহিল,—“পিপাসাও আমাদের পায়, স্নেহময়ী নারীর মুখ দেখতে পেলে আমাদেরো দুটি দণ্ড কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সময় নেই। কত কাজ বাকি, কত পথ এখনো উত্তীর্ণ হতে হবে—আমি চল্লাম। তোমাকে বিশেষ কিছু উপহার দিয়ে যেতে পারলুম না—যদি পারি কিছু টাকা পাঠাবো। তা দিয়ে যা তোমার খুসি কিনে নিয়ে। কিনে দিয়ো হে প্রদীপ। শাড়ি ব্লাউজ জুতো গয়না—যা ওর পছন্দ। এখনো যে ভোল ফেরায়নি দেখছি।” বলিয়া অজয় দরজার বাহিরে পা বাড়াইল।
পিছন হইতে নমিতা হঠাৎ তাহার বা হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া আকুলকণ্ঠে কহিল,-“আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চল। তোমার অসুথ, কে তোমাকে দেখবে বল।”
প্রথমটা কথা শুনিয়া অজয়ের সমস্ত চেতনা যেন ঘুলাইয়া উঠিল। অন্ধকারে নমিতার মুখ স্পষ্ট চোখে পড়ল না; সে-মুখ দেখিতে পাইলে হয় ত’ সে একটু দ্বিধা করিত, হয় ত’ এমন কঠোর ঘুণায় সে-স্পর্শকে উপেক্ষা করিতে পারিত না।
অজয় তাহার হাতটা ঠেলিয়া দিয়া কহিল,-“আমার সঙ্গে যাবে মানে?”
—“হ্যাঁ, যাব; যেখানে তুমি নিয়ে যাবে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে বলেই ত’ এত দিন প্রতীক্ষা করে বসে আছি।”
অজয় আকাশ হইতে পড়িল : “এ এ-সব কী বলছে হে প্রদীপ? তুমি কোনো কথা কইছ না কেন?”
প্ৰদীপ দূরে জানালার কাছে সরিয়া গেল। নমিতাই বলিয়া উঠিল : “কে কী বলবে–কার কী সাধ্য আছে শুনি? তুমি একদিন আসবে সেই আশায় আমি আজো বেঁচে আছি। কে আমাকে বাধা দেয়?” বলিয়া নমিতা অজয়কে একেবারে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।
নিশ্বাস ফেলিবার সময়টুকু পৰ্য্যন্ত কাটিল না। নমিতাকে ডান হাতে ঠেলিয়া ফেলিয়া অজয় কহিল,—“সরে দাঁড়াও শিগগির। ছুঁয়ে
না আমাকে। তুমি এতদুর নির্লজ্জ হয়েছ জানলে এখানে মরতেও আসতাম না কোনোদিন। তোমার ছোঁয়া খাবার খেয়েছি ভেবে সারা শরীর আমার অশুচি হয়ে গেছে।”
নমিতা বাঁশের একটা খুটি ধরিয়া নিজেকে রক্ষা করিল।
কটু কদৰ্য্য কণ্ঠে অজয় কহিল,—“এক জনকে তার ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট করে’ পথে বসিয়েছ, তবুও তাতে তোমার তৃপ্তি হ’ল না? এত সহজেই তোমার অরুচি ধরে গেল? ভেবেছ আমার সঙ্গে চলতে গিয়ে এক সময় জিরোতে চাইবে, পথের থেকে কাঁধে উঠতে চাইবে—অজয় অমানুষ মেয়েমানুষকে অতটা প্রাধান্য দিতে শেখেনি। লজ্জা করে না?—কে তোমাকে বাধা দেবে! বাধা দেবে তোমার লজ্জা, তোমার চরিত্র।”
অজয় পা বাড়াইয়াছিল, নমিতা আবার কাছে ছুটিয়া আসিল। সে কঁদিতেছে। কহিল,—“চরিত্র আমি মানি না, মানি আমার মনকে। সেই আমার মণি, সেই আমার সব। তুমি যেয়ো, তোমার সঙ্গেও আমি যেতে চাই নে, কিন্তু আর খানিকক্ষণ তুমি থেকে যাও। আজকের রাতটা।”
—“তোমার ঘরে? ঐ বিছানায়? সরে দাঁড়াও, নমিতা।”
নমিতা প্রখরকণ্ঠে কহিল,—“কেন, একটা রাত্রি একাকিনী নারীর ঘরে আত্মদমন করে থাকতে পারো না?”
অজয় উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল : “তুমি আমাকে লোভ দেখাচ্ছ বুঝি? আত্মদমনের চেয়েও অজয়ের জীবনে মহত্তর আদর্শ আছে। তুমি তার মহিমা বুঝবে না—পথ ছাড়। যেতে দাও আমাকে। একাকিনী নও, ঐ প্রদীপ দাঁড়িয়ে। নিষ্ঠা বলে জিনিসটাকে একেবারে অমান্য করো না। সতী নাই বা হলে, কিন্তু তাই বলে অসৎ হতে হবে?”।
নমিতা সরিয়া দাঁড়াইল। মুখে একটিও কথা নাই।
—“পথে বেরুবো বললেই কি আর বেরুনো যায়? পথ তোমাকে গ্রহণ করবে কেন? তোমার ছাড়পত্র কোথায়? ঘরে যাও, দরজাজানালা বন্ধ করে বিছানাটা উত্তপ্ত করে রাখ গে—রাত্রে ত’ আবার ঘুমুতে হবে। চল্লাম হে প্রদীপ, সুইট ড্রিমস্!” বলিয়া সেই ঝড়-জলের। মধ্যেই অজয় অদৃশ্য হইয়া গেল।
২৩. কোথায় মরতে যাব
প্রদীপ কহিল,—“অজয়ের সঙ্গে গেলে না? নিলো না বুঝি?”
নমিতা রুখিয়া উঠিল : “কোথায় মরতে যাব ওর সঙ্গে? তার চেয়ে এই আমার ঢের ভালো।” বলিয়া ভোলা জালাগুলি সে বন্ধ করিতে লাগিল : “জলে কী হয়েছে দেখুন-ঘরের মধ্যে নদী বইছে। মেঝেটা লেপতে হবে।”
—“এখন থাক।”
—“এখন থাকবে কী! ঘুমুনো যাবে নাকি তা হ’লে? উনুনটুনুও বোধহয় ভেসে গেল। একটা হাক দিন্ না, মথুর কিছু খাবার জোগাড় করে নিয়ে আসুক। টিফিন্-কেরিয়ারে যা ছিল সব উজোর করে খেয়ে গেছে”।
—“তোমার খুব খিদে পেয়েছে নাকি?”
তরলকণ্ঠে নমিতা কহিল,—“আহাহা, রাত্রে যেন আমি কত খাই। আপনার জন্যে বলছি—সারাদিন ত’ পেটে কিছু পড়ে নি। শরীরটা ত’ গেল। যা হোক, উনুটা ধরিয়েছিলাম, ঝড় আর আপনার বন্ধু এসে সব মাটি করে দিল। ডাকুন না মথুরকে।”
একটা ন্যাড়া দিয়া নমিতা ঘর মুছিতেছিল, আভরণহীন সেই হাতখানির দিকে চাহিয়া থাকিয়া প্রদীপ কহিল,—“মথুরকে ডেকে কাজ নেই। সত্যি আমার একটুও খিদে পায় নি।”