খোঁপাটা বাঁধিল না পর্যন্ত, সুতীব্র আলোর ঝাঁজে চক্ষু দুইটা আবিষ্ট হইতে না দিয়া অপলক চোখে অজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কিন্তু অজয়ের এ কী শ্রী! কোথায় সেই দুর্লভ তেজ, সেই গৰ্বদৃপ্ত ঋজুতা? মুখমণ্ডলে গাঢ় রোগমালিন্য, কত স্বপ্নের ব্যর্থতা যেন মুদ্রিত হইয়া আছে। বেশবাস অপরিচ্ছন্ন, এক হাঁটু কাদা, জলে ভিজিয়া কিছু আর নাই। সেই মূর্তি দেখিয়া নমিতা আনন্দধ্বনি না হাহাকার করিয়া উঠিবে কিছুই বুঝিতে পারিল না।
অজয় হাসিয়া কহিল,—“খুব অবাক হয়ে গেছ দেখছি। আমি ভূত নই, নেহাৎই বর্তমান। জলে ভিজে বহু কষ্টে ষ্টেশন থেকে পথ চিনে এসেছি। প্রদীপ কৈ?”
নমিতা কহিল,—“বোস। পাশের ঘরে আছেন বোধহয়, ডেকে আছি।”
পাশের ঘরেও প্রদীপ তাহার নিঃসঙ্গ বিছানায় বসিয়া ঝড় দেখিতে ছিল। সে-ঝড়ে সে বিপুল সম্ভাবনার সঙ্কেত খুঁজিয়া পায় নাই, এঅন্ধকার যেন তাহার জীবনে রাশি রাশি বিষন্নতা নিয়া আসিয়াছে। অচরিতার্থতার এমন রূপ আর সে কবে দেখিয়াছে? এত বড় বিস্তৃতির মধ্যে তাহারই জন্য কোথাও এতটুকু মুক্তি রহিল না!
নমিতা তাড়াতাড়ি তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, প্রদীপ টের পায় নাই। কি বলিয়া তাহাকে সে এই সংবাদ দেয় কিছুই ভাবিয়া পাইল না। হঠাৎ তাহার মাথায় এক ঠেলা দিয়া কহিল,—“শিগগির দেখবেন আসুন—কে এসেছে।”
প্রদীপ ধড়মড় করিয়া উঠিল : “কে? আবার পুলিশ নাকি?”
—“না, না। শিগগির আসুন।”
ঘরের কোণ হইতে লণ্ঠনটা লইয়া নমিতার পিছু-পিছু প্রদীপ অগ্রসর হইল। ঘরের মধ্যে আসিয়া দেখিল ডান-হাতে একটা টর্চ জ্বালিয়া দাঁড়াইয়া আছে—আর কেহ নয়, অজয়। সহসা প্রদীপ যেন এতটুকু হইয়া গেল।
প্রদীপকে দেখিয়া বিদ্রুপাত্মক অভিবাদন করিয়া অজয় কহিল, “ধন্যবাদ।”
প্রদীপ আরো একটু আগাইয়া আসিল বটে, কিন্তু বন্ধুর হাত ধরিতে সাহস পাইল না। খালি কহিল,—“তুমি? হঠাৎ? কোথেকে?”
অজয় কহিল,—“আসৃচি অনেক দূর থেকে। হঠাৎই আমি এসে থাকি। খবরের কাগজে তোমাদের কীর্তির কথা আদ্যোপান্ত পড়লাম,
-বেশ, তোমাদের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করছি। তার পর?”
কাহারও মুখে কথা জুয়াইল না। খানিক বাদে স্নিগ্ধস্বরে নমিতা কহিল,—“একেবারে ভিজে গেছেন দেখছি”
—“ভিজতে আমাকে আরো অনেক হবে। রাত্রে আজ আর জল থামবে বলে মনে হয় না।”
প্রদীপ কহিল,—“এক্ষুনি আবার চলে যাবে নাকি?”
—“নিশ্চয়। এক জায়গায় বেশিক্ষণ জিরোবার আমার সময় নেই। কিন্তু ঘর-দোরের এ কী হাল-চাল করে রেখেছ? টাকা-পয়সার টানাটানি বুঝি? তা আমার কাছেও কিছু নেই।”
একটু থামিয়া পরে আবার কহিল,—“দেশে ফিরে ভারি মজা দেখলুম প্রদীপ; বাবার সেই বাৎসরিক পনেরো হাজার টাকা দিব্যি উড়ে গেছে গ্লাশে আর বিলাসে! আমি যেই একা, সেই একা। তার পর, পল্লী-সংস্কারের বকশিস্ বাবদ সেই যে ম্যালেরিয়া পেয়েছিলুম, তাতে হাড়-মাস আমার ঝরঝরে হয়ে গেল। তার পর একটি করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া : “তোমাদের সেই অজয় আর নেই। তোমাদের দেখতে নিদারুণ ইচ্ছা হ’ল বলেই জ্বর নিয়েও জলের মধ্যে চলে এসেছি। এখন ত দিব্যি একটি রাণী পেয়েছ, এবার স্বচ্ছন্দে নিরীহ একটি কেরানি বনে’ যাও, কিম্বা লাইফ, ইসিয়োরেন্সের এজেন্ট, কিম্বা ধরে পাটের বা মাছের দালাল—কি বল?”
প্রদীপ অভিমান করিয়া কহিল,—“একটা কিছু নিশ্চয়ই হ’তে হবে, সে-পরামর্শ তোমার কাছ থেকে না নিলে কিছু এসে যাবে না।”
স্বচ্ছ হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করিয়া অজয় কহিল,—“ভালো। একটা ইস্কুল-মাষ্টারিও মন্দ হবে না। তার পর নমিতা, ফোটো পূজো করতে করতে সুরাহা একটা কিছু হ’ল তা হ’লে? বেশ।”
নমিতা একটিও কথা কহিল না, গভীর দৃষ্টিতে অজয়ের মুখের দিকে চুলের দিকে কাপড়ের দিকে পায়ের দিকে চাহিতে লাগিল।
—“কি, কথা কইছ না কেন? আমি তোমাদের এমন সন্ধ্যাবেলাটা মাটি করে দিলাম নাকি?”
নমিতা কহিল,—“বসুন, জামা-কাপড়গুলো ছাড়ুন, আপনার প্রত্যেক কথার উত্তর দিচ্ছি।”
—“আমার সময় কৈ? প্রতি নিশ্বাসে আমার বৎসর চলে যাচ্ছে।” তার পর হাসিয়া কহিল,—“কী বা আমার কথা, তার আবার উত্তর! কোর্টে দাঁড়িয়ে যাত্রা দলের ঢঙে কী তোফা বক্তৃতাই যে তুমি দিয়েছ
—ক্যাপিট্যাল! কিন্তু, কিছু খেতে দিতে পারো, নমিতা? ভারি খিদে পেয়েছে।”
নমিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিল : “নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু আপনার যে জ্বর!”
অজয় বাধা দিয়া কহিল,—“হোক জ্বর। তা এমন কিছু মারাত্মক নয় যে তোমার হাতের খাবার খেলে আমাকে চিতেয় উঠতে হবে। আজ আমি তোমার কাছে সেদিনের মত জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে আসিনি, নিতান্ত সাদা ভাষায় কিছু খাবার ভিক্ষা করছি মাত্র। আমাকে আজো তোমার সন্দেহ হয় নাকি? আজ আর তোমাকে বাইরে আহ্বান করবার ভাষা নেই, এই ঘরেই তুমি সমস্ত পৃথিবী লাভ করেছ। ও কি, তুমি রাঁধতে চললে নাকি? পাগল! আমার এত খিদে বা সময় নেই যে বাবু সেজে আসন-পি ড়ি হয়ে যোড়শোপচার সাবাড় করব। ঘরে তোমাদের গেলবার কি কিছুই নেই? কী ছাই তবে ঘর করেছ, নমিতা!”
পথে খাইতে উমার-দেওয়া খাবারগুলির কথা মনে করিয়া নমিতা। কহিল,—“আছে কিছু, তবে তা বাসি, কালুকের রাতের তৈরি।”
—“বাসি! নিয়ে এসো চট্ করে? বলে কি না বাসি! পেলে। বাঁশ চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি—”
নমিতা টিফিন-কেরিয়ারের বাটিটা লইয়া আসিল।
অজয় একেবারে শিশুর মত হাত বাড়াইয়া বাটিটা গ্রহণ করিল। নমিতা কহিল,—“দাঁড়া একটা প্লেট নিয়ে আসছি।”