—“মিথ্যা কথা বৈ কি।” নমিতা রুক্ষস্বরে কহিল,—“আত্মতৃপ্তির জন্যে কে কবে না মিথ্যা বলেছে? আমি বলিনি? কাল কোর্টে সমস্ত লোকের সামনে?”
বিমূঢ় হইয়া প্রদীপ কহিল,—“তুমি নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এসেছ—এ তোমার মিথ্যা কথা?”
নমিতা উদাসীনের মত কহিল,—“কেন হ’তে যাবে। দাও তোমার খাবার উমা, কাটলেটগুলো প্রদীপবাবুকে খেতে বল।”
উৎফুল্ল হইবার ভাণ করিয়া প্রদীপ কহিল,—“তা আর বলতে হবে
। কিন্তু মা যখন জিগগেস করবেন খাবারগুলো কী হ’ল তখন কি বলবে, উমা?”
নমিতা উত্তর দিল : “বলবে রাত্রে বন্ধু না-আসাতে সকালবেলায় সেগুলো আঁস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি। দাও, উমা, গাড়ি এবার ছাড়বে।”
জালা দিয়া টিফিন্-কেরিয়ারটা তুলিয়া দিয়া উমা গাঢ়স্বরে প্রশ্ন করিল,—“আবার কবে দেখা হবে, বৌদি?”
—“দেখা বোধহয় আর হবে না, উমা। নিরুদ্দেশ যাত্রার কি আর কোথাও পার আছে?”
ফ্ল্যাগ নড়িল, বাঁশি বাজিল, আর একটিও কথা বলিবার আগে গাড়ি ছাড়িয়া দিল। উমা নড়িল না; চিত্রার্পিতের মত মূক নিষ্পন্দ হইয়া প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়াইয়া রহিল। জালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া নমিতা দেখিল, উমার দৃষ্টি ধাবমান ট্রেন্টাকে অনুসরণ করিতেছে না, মাটির উপর নিবদ্ধ হইয়া আছে।
ক্রমে এই দৃশ্যটুকুও অপসৃত হইয়া গেল।
বেঞ্চির এক ধারে উঠিয়া আসিয়া প্রদীপ কহিল,—“কী আর মিথ্যা কথা বলে’ এসেছ, নমিতা?”
নমিতা কঠিন হইয়া কহিল,-“কোটা মিথ্যা কোটা সত্য তা আপনি আজো অনুভব করতে শেখেন নি?”
—“খুব শিখেছি। তাই তোমার আচরণের কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেলাম না। গলার মালার বদলে পায়ের শৃঙ্খল হয়ে যদি আমাকে আটকে রাখতে চাও, সে-বাধা আমি সইবো না, নমিতা।”
—“সইতে কে আপনাকে বলছে? আপনি যা না যেখানে খুসি,-কপালের নীচে আমারো দুটো চোখ আছে।”
—“তবে শুধু-শুধু কেন আমাকে জেল থেকে টেনে রাখলে? আমি না হয় অমনি করে’ই মতাম।”
হাসিয়া নমিতা কহিল,—“মরবার আরো অনেক পথ ছিলো, প্রদীপবাবু।”
কিন্তু সেই ফুলহাটিতেই ফিরিয়া আসিতে হইল। প্রদীপ কহিল, “আমারই সঙ্গে এলে যে বড়?”
নমিতার মুখে সেই হাসি : “আপনি ছাড়া কে আর আমার সঙ্গী আছে বলুন। আমার জীবনে আপনার মূল্য কি একটুখানি? আপনি আমাকে কলঙ্ক দিলেন, আপন অধিকারের গর্ব করতে শেখালেন আমি অত বড় অকৃতজ্ঞ নই যে এই বনে-জঙ্গলে আপনাকে একা ফেলে পালিয়ে যাবে।”
—“কিন্তু বনে-জঙ্গলে তুমি ত’ আর কোনোদিন ঘর বাঁধবে না।”
—“ঘর বাঁধবার জন্যেই ত’ আর পথ নিই নি।”
নমিতা ঘর বাঁধিবে না বটে, কিন্তু ফুলহাটির এই শ্রীহীন শূন্য পুরীতে পা দিতে না-দিতেই সে দুইটি কল্যাণময় ক্ষিপ্রহাতে তাহার সংস্কারসাধনে তৎপর হইয়া উঠিল। তাহার সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া সেন গৃহলক্ষ্মীর মঙ্গলমাধুৰ্য্য! এইবার আর মথুরকেও ডাকিতে হইল না। যে বিছানা দুইটা দুই কোণে ধূলিলিপ্ত অবস্থায় পড়িয়া ছিল তাহাদের ঝাড়িয়া-পুছিয়া রোদে দিয়া সে খটখটে করিয়া তুলিল, ঘর নিকাইল, কাপড় কাচিল এবং সন্ধ্যা হইতে না হইতেই রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। প্রদীপ যখন হাসিয়া কহিল : “আকাশে দিব্যি মেঘ করেছে, নমিতা, একবার নদীর ধারটায় বেড়াতে যাবে না?” নমিতা কথাটাকে উপেক্ষা করিয়া কহিল : “আমার এখনো কত কাজ বাকি।”
হঠাৎ একটা মেঘ ডাকিয়া উঠিতেই নমিতা সন্ত্রস্ত হইয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিল ঘন নিবিড় মেঘে সমস্ত আকাশ বেদনার্ত মুখমণ্ডলের মত থমথম্ করিতেছে। জীবনে সে এত বড় আকাশ দেখে নাই, পুঞ্জিত নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া গৰ্জ্জমানা নদীর ডাক যেন তাহার বুকে আসিয়া আঘাত করিল। কিসের তাহার গৃহ, কিসের বা তাহার গৃহকৰ্ম্ম! নমিতা মাঠের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল—দিত্মণ্ডল ছাপাইয়া অন্ধকারের অজস্র বন্যা নামিয়া আসিয়াছে। আকাশে মুক্তবেণী ঝটিকা, নীচে নমিতা যেন শরীরিনী বিদ্রোহবহ্নি!
সঙ্গে সঙ্গেই জল আসিয়া গেল বলিয়া সে আর বেশিক্ষণ বাহিরে দাঁড়াইতে পারিল না। নিজের ঘরে আসিয়া বিছানার উপর চুপ করিয়া বৃসিয়া পড়িল। ঘরের সবগুলি দরজা-জানলা খোলা, জোরে জলের হাটু আসিতেছে, তবু তাহার খেয়াল নাই। চরাচরপ্লাবী অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া সে কাহার অনুসন্ধান করিতেছিল সেই জানে। কেন সে এইখানে আসিয়াছে, কোথায়ই বা আবার এমন মুক্তবন্ধ গগন-বিহঙ্গ মেঘের মত কোন্ অপরিচিত দেশের দিকে ভাসিয়া পড়িবে—আজিকার দিনে সে-সব সমস্যা তাহাকে একটুও আলোড়িত করিতেছে না। সে যেন জানিত আজ আকাশে ঝড় আসিবে। সে আরো অনেক কিছুই জানিত!
কতক্ষণ তন্ময় হইয়া বসিয়া ছিল খেয়াল নাই, হঠাৎ তাহার আচ্ছন্ন চোখের সামনে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ভাসিয়া উঠিল। নমিতা চঞ্চল হইল না, লোকচক্ষুর অগোচরে আত্মার দর্পণে সে বারে বারে যাহার ছায়া দেখিয়াছে, আজিকাব এই ছায়াচ্ছন্ন প্রদোষে এ বুঝি তাহারই প্রতিচ্ছবি! কিন্তু হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা টর্চ জ্বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিভিয়া গেল। এক ঝলক্ তীব্র আলোতে ঘরের রাশীকৃত অন্ধকার যেন বিকট হাস্য করিয়া মূচ্ছিত হইয়া পড়িয়াছে। আশ্চৰ্য, নমিতা একটুও ভীত হইল না।
কাহার স্বর শোনা গেল : “ধন্যবাদ।”
আবার সেই পীভূত স্তব্ধতা। এইবার অজয় টর্চটা টিপিয়া তক্ষুনি আঙুলটা সরাইয়া নিল না। হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“তুমি একলা। বসে’? প্রদীপ কোথায়?”
ইহাতে অভিভূত হইবার কি আছে? উমা যদি কাল রাত্রে ভাবিয়া থাকে যে তোরবেলা ষ্টেশনে গেলেই প্রদীপের দেখা পাইবে, তবে নমিতার এত রাত্রের প্রতীক্ষা-স্বপ্ন কি জীবনের একটি দিনেও সফল হইতে পারিবে না? সে মাথার উপর ঘোম্টা তুলিয়া দিল না,