উমা বিরক্ত হইয়া কহিল,—“ওঁর জেল হতে যাবে কেন? কী বলছেন আপনি?”
গিরিশবাবু হতভম্ব হইয়া কহিলেন,—“বা, এই যে বল্লে নমিতা মামলা জিতেছে?”
—“জিতেছেনই ত’? সমস্ত পৃথিবীর সামনে সোজা সত্য কথা স্পষ্ট করে বলে’ আসতে পেরেছেন। মানুষের এর চেয়ে আর বড় জয় কিছু আছে নাকি? কেউ বউদিকে ছিনিয়ে নিতে পারে নি, তিনি নিজের আত্মার শক্তিতে নিজের স্বাধীনতা সৃষ্টি করেছেন। যান, জেল-ফেল হয়নি কারুর কোনোদিন।”
গিরিশবাবু আকাশ হইতে পড়িলেন আর কি : “বল কি উমা? নমিতা নিজের ইচ্ছায় বাড়ির বার হয়েছে? তবে কার বিরুদ্ধে এই মালা? এ! কোথায় যাচ্ছ তবে তোমরা?”
নিতান্ত জ্ঞানীর মত মুখ করিয়া উমা কহিল,—“ কে কবে বলতে পারে বলুন, কোথায় কে যাচ্ছে?”
গাড়িটা চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল, গিরিশবাবু, ধমক দিয়া উঠিলেন : “শোন নমিতা, কেন তবে ঘর ছেড়েছিলি শুনি? কার জন্যে?”
উমা বলিয়া উঠিল : “কার জন্যে আবার লোকে ঘর ছাড়ে? নিজের জন্যে।—চালাও জলদি।”
গিরিশবাবুকে আর একটি কথাও বলিতে না দিয়া ট্যাক্সিটা বাহির হইয়া গেল। ছাতা হাতে করিয়া গিরিশবাবু ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলেন।
নমিতা মুগ্ধচোখে উমার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। খানিকপরে তাহার একখানি হাত নিজের হাতের উপর টানিয়া আনিয়া কহিল, “এত কথা তুমি কোথেকে শিখলে, উমা?”
উমা হাসিয়া কহিল,—“তোমারই কাছ থেকে, বৌদি।”
অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। ট্যাক্সিটা যে কোথায় চলিয়াছে, যেন কাহারো কোনো দিশা নাই। প্রদীপ সহসা সচেতন হইয়া কহিল, “তুমি আমাদের সঙ্গে কোথায় যাবে, উমা?”
মানুষের মন, না পদ্মপাতায় জলবিন্দু। নিমেষে উমার সমস্ত উৎসাহ উবিয়া গেল; মুখোনি স্নান করিয়া সে কহিল,—“না, কোথায় আবার যাব? আমার আর কাজ কি আছে? এই, রোখো।”
গাড়ির গতিটা একটু কমিতেই দরজা খুলিয়া উমা নামিবার জন্য পা-দানিতে পা রাখিল।
প্রদীপ ব্যস্ত হইয়া কহিল,-“এখানে নামূবে কি? এখান থেকে তোমাদের বাড়ি যে ঢের দূর।”
—“হোক। আপনাদের সঙ্গে গিয়ে আমার আর কী হবে?” বলিয়া উমা সোজা ফুটপাতে নামিয়া আসিল।
প্রদীপ গাড়িটাকে চলিতে বলিতে পারিল না। বরং হাত তুলিয়া অভিমানিনী উমাকে ডাকিতে সুরু করিল।
নমিতা বাধা দিল : “ওকে ডেকে কোথায় নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে? ও বাড়ি যাক্। চলল।”
গাড়িটা গড়াইয়াছে, অমনি ছুটিয়া উমা ফের হাজির হইল। কহিল,—“তোমাকে প্রণাম করা হয় নি, বৌদি। মনে যদি কোনোদিন দুঃখ দিয়ে থাকি, ভুলে যেয়ো। আর কোনোদিন দেখা হয় কি না কে জানে।” বলিয়া দরজা খুলিয়া সে নমিতার পদধূলি নিল।
নমিতার দুই চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল; চোখ মুছিয়া ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল, উমা পাশের কোন গলি দিয়া সহসা কখন অদৃশ্য হইয়া গেছে।
২২. পর দিন কি ভাবিয়া ভোর বেলা
কিন্তু পর দিন কি ভাবিয়া ভোর বেলাতেই যে উমা একটা টিফিকেরিয়ার লইয়া ষ্টেশনে আসিয়া হাজির হইল তাহা সে-ই জানে। কাল সারা রাত ধরিয়া প্রতি মুহূর্তে মনে যাহা ডাক দিয়া ফিরিয়াছে তাহা কি পূর্ণ না হইয়া পারে? তাই দূরে প্ল্যাটফর্মে পাশাপাশি প্রদীপ ও নমিতাকে ট্রেনের দিকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া সে আর কোনো রোমাঞ্চকর বিস্ময়বোধ করিল না, আজিকার সূর্যোদয়ের মতই যেন তাহা অতি সাধারণ। দূর হইতেই প্রদীপ কহিয়া উঠিল : “তুমি আবার কোখেকে হাজির হ’লে, উমা? বাঃ।”
দুইজনে যতক্ষণ না একেবারে কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, উমা শব্দ করিল না। কাছে আসিতেই সে বুঝি প্রদীপের হাত ধরিতে গিয়া নমিতার হাত ধরিয়া ফেলিল। কহিল,—“তোমাকে আরেকবার ভারি দেখতে ইচ্ছা করছিলো, বৌদি। এই জন্যে কাল বারে বারে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। খালি মনে হচ্ছিল তোমার কাছ থেকে ভালো করে বিদায় নেওয়া হয় নি।”
নমিতা যেন উমার মনের বেদনা দেখিয়া ফেলিয়াছে। তাই তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া সস্নেহে কহিল,—“তুমিও আমাদের সঙ্গে চল, উমা।”
দুইটি আনন্দপুর্ণ চক্ষু তুলিয়া উমা কহিল,—“আমারো তাই ভারি সাধ হয়, বৌদি। কোথায় যেন চলে যেতে ইচ্ছা করে।”
প্রদীপ কথাটা শুনিয়া ফেলিয়াছিল। হাসিয়া কহিল,—“তুমি গেলে। এবার আমার জেল আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। শচীপ্রসাদ নিশ্চয়ই তা হ’লে দাঁত বত্রিশটা গুড়ো করে দেবে। কাজ নেই উমা, ফুলহাটিতে ফলস্ দাঁত কিনতে পাব না।”
দুইজনে ট্রেনের কামরায় গিয়া উঠিল। নমিতা কহিল,—“ভেতরে একটু বসবে, উমা?”
—“কাজ নেই বৌদি। গাড়ি এক্ষুনি ছেড়ে দেবে। শেষে যদি নামতে না পারি?”
একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া নমিতা কহিল,—“হাতে তোমার ওটা কী?”
সচেতন হইয়া উমা কহিল,-“তোমার জন্যে কিছু খাবার তৈরি করেছিলাম, বৌদি। নাও, ধর।”
—“খাবার? কী আছে ওতে?”
—“কিছু কাটলেট—”
হাসিয়া ফেলিয়া নমিতা কহিল,—“কাটলেট! আমি যে বিধবা সে-কথা তুমি রাতারাতি ভুলে গেলে নাকি উমা?”
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলাইয়া উমা কহিল,—“না না কচুরি আছে, গজা আছে-লুচি, তরকারি, চাটনি-কাল সন্ধ্যাবেলা সব তৈরি করেছি। বসে বসে। মা জিগগেস করলে বল্লাম : এক বন্ধুর আজকে নেমন্তন্ন আছে, মা। তা, বন্ধু যদি সারা রাতে না আসে, তবে আমার আর কী দোষ বল? তুমি খেয়ো, বৌদি। খুব পরিষ্কার আছে সব—”
হাসিয়া প্রদীপ কহিল,—“বৌদির জন্যে তোমার এত মায়া, উমা! খাওয়াবার জন্যে মা’র কাছে পৰ্যন্ত মিথ্যা কথা বলে।”