—“পুলিশের কাছে কি বলেছি আমার কিছু মনে নেই। উল্টো কথা কিছু যদি বলে থাকি, তবে এই জন্যেই হয় ত’ বলেছিলাম যে, এমনি একটা উন্মুক্ত সভায় সর্বসাধারণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুক্তি ঘোষণা করতে পাব। যা আমি নিজে সৃষ্টি করলাম, তা পরের সাহায্যে যে মোটেই লাত করিনি, সেইটে উঁচু গলায় বলবার জন্যে আমি একটা সুযোগ চেয়েছিলাম মাত্র। এর চেয়ে সোনার সুযোগ কী হতে পাত? নেপথ্যে বা স্বপ্নে বা পুলিশের কাছে আমি যা বলেছি তার মূল্য নেই, স্পষ্ট দিবালোকে সজ্ঞানে ধর্মাধিকরণের সামনে যা বলছি তাই আমার সত্য। উল্টো কিছু বলা বা প্রলাপ বকার জন্য যদি শাস্তির বিধান থাকে, তা আমি নেব; কিন্তু আহ্বান যদি কেউ কাউকে করে থাকে, তবে আমিই প্রদীপবাবুকে করেছি, উনি আমাকে নয়। উনি আমার বন্ধু, আশ্রয়দাতা। যদি এও শুনতে চান, আমি বলব, ঐ আসামীকে আমি ভালোবাসি।”
স্তব্ধ ঘর নিশ্বাস ফেলিল; দেয়ালগুলি পর্যন্ত কাপিয়া উঠিয়াছে। অবনীবাবু কহিলেন,—“চলে’ এস শচীপ্রসাদ। এর পর ঘাড়ের ওপর মাথা নিয়ে আর লোকসমাজে ফিরতে পাবে না। ছি ছি ছি।”
উমা ভিড়ের মধ্যে কোনরকমে আত্মগোপন করিয়া রহিল। উকিল বাবুটি কাছে আসিয়া স্নিগ্ধ-স্বরে কহিলেন,—“আমাকে কিছু বলতেও হ’ল না। মেয়েদের বয়েসই হচ্ছে বাঁচোয়া, বুঝলেন? কবে খাওয়াচ্ছেন বলুন।”
মুখ বিবর্ণ করিয়া উমা কহিল,—“আপনাকে আমি ভুলবো না। আপনি আমাকে খুব সাহস দিয়েছিলেন কিন্তু।”
কিন্তু উমার চেহারায় সাহসের এক কণাও ভদ্রলোকের চোখে পড়িল না। মুখ ছাইয়ের মত শাদা, দুই চোখে কেমন একটা নিরীহ, অসহায় ভাব। কপালের উপর বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিয়াছে। ভদ্রলোকটির কেন-জানি মনে হইল সৰ্বান্তঃকরণে মেয়েটি হয় ত’ ইহা চাহে নাই। কোথায় যেন একটু আশা-ভঙ্গের মনস্তাপ রহিয়াছে।
প্রদীপ ও নমিতাকে ঘিরিয়া তখনো ভিড় লাগিয়া আছে। দুইজনেই নির্বাক, সবাইর প্রতি সমান উপেক্ষা। শচীপ্রসাদেরই আফশোষ ঘুচিতেছে না; সে সক্রোধে দুইহাতে ভিড় ঠেলিয়া নমিতার সামনে আসিয়া কটুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল : “কেন এই কেলেঙ্কারি করে’ বসলেন বলুন ত’? আমাদের মুখ ঢাকবার আর জায়গা রইল না যে।”
অবনীবাবু দূর হইতে চেঁচাইয়া উঠিলেন : “ঐ হতভাগীর সঙ্গে কথা বলে না, শচীপ্রসাদ। যাক্ ও জাহান্নমে,—চলে এস, শচী।”
যাইতে যাইতে শচীপ্রসাদ কহিল,-“এর চেয়ে গলায় কলসী বেঁধে জলে ডুবে মরলেও যে ভালো ছিল!”
দুই জনে ধীরে ধীরে জনস্রোত সরাইয়া রাস্তার বাহিরে আসিয়া পঁড়াইল। প্রদীপ কহিল,—“এখন কোথায় যাবে, নমিতা?”
নমিতার মুখে অটল গাম্ভীৰ্য—যেন পরপার হইতে কথা কহিতেছে : “আমি কি জানি?”
—“সম্প্রতি একটা গাড়ি নেওয়া যাক্, নইলে এভিড় এড়ানো সহজ হবে না। দু’ দিন কিছু খেতে পাই নি নমিতা, পেট চো চেষ্টা করছে। কিছু না খেলে চলবে না যে।”
নমিতা উদাসীনের মত কহিল,-“বেশ, তবে গাড়ি করুন।”
—“গাড়ি ত’ করবে কিন্তু কে এখন আমার জন্যে আর ভাত বেড়ে রেখেছে বল?”
—“কেন, হোটেল। কলকাতা শহরে হোটেল নেই?”
—“তুমি আমার সঙ্গে যাবে হোটেলে?”
—“আপনার সঙ্গে যেতে আমার আর বাধা কোথায়?”
ড্যালহৌসি স্কোয়ারের পাশে আসিয়া ট্যাক্সিতে উঠিয়াছে—প্রায় ছুটিতে ছুটিতে উমা আসিয়া হাজির : “আমাকে চিনতে পারে, দীপ-দা?”
—“তুমি এখানে উমা?” প্রদীপের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না : “উঠে এস, উঠে এস শিগগির—”
নমিতা এক পাশে সরিয়া গিয়া উমাকে তাহাদের মধ্যখানে বসিতে দিল।
তবুও গাড়িটা তখনই ছাড়িতে পারিল না। কে একজন ডান হাতে ছাতা তুলিয়া গাড়িটাকে লক্ষ্য করিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে ছুটিয়া আসিতেছে। নমিতা তাহার গভীর হৃদয়ের মধ্যে যেন কাহার ডাক শুনিয়া চমকাইয়া উঠিল। ইহাকেই সে যেন বিনিদ্র ব্যাকুল চোখে এতদিন প্রতীক্ষা করিয়া ফিরিতেছিল। কিসের বা তাহার মুক্তি, কী বা তাহার সত্য!
কোর্টে আসিতে গিরিশবাবুর দেরি হইয়া গিয়াছিল; দুর হইতে দেখিতে পাইলেন একটা ট্যাক্সিতে করিয়া নমিতা কাহাদের সঙ্গে চলিয়াছে। সামনে আসিয়া চোখে তাহার ধাঁধা লাগিল। চোখ কচলাইয়া নমিতাও চাহিয়া দেখিল—তাহার কাকা ছাড়া পিছনে আর কেহ নাই। গিরিশবাবু ট্যাক্সির গা ঘেঁসিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “কী হ’ল?”
কথা কহিল উমা : “কী আবার হবে? বৌদি জিতেছেন।”
—“জিতেছে?” গিরিশবাবু লাফাইয়া উঠিলেন : “কয় বচ্ছর জেল হ’ল গুণ্ডাটার?”
উমা তীক্ষ্ণস্বরে কহিল,—“গুণ্ডা আবার আপনি কাকে দেখলেন?”
—“গুণ্ডা নয়, একশো বার গুণ্ডা! ছোঁড়াটার মাথায় যেমন একরাশ চুল, চোখ দুটো ভাটার মত, হাতের মুঠো যেন বাঘের থাবা
ওটাকে আমি বরাবরই রাখতে চাইনি বাড়িতে। নেহাৎ ওর দিদির আবদারেই ছিলো, তা দিদিকে কি আর কম জ্বালিয়েছেন সোনার চাদ! ক’ বছর হ’ল?”
—“কা’র কথা বলছেন আপনি?”
—“কেন, অজয়ের। সে ইতিমধ্যে এসেছিলো একদিন আমার বাড়িতে; এসে বল্লে : নমিতা কোথায় আছে জানেন? শ্বশুরবাড়িতে তাকে খুঁজে পেলাম না। কী ভীষণ চটে উঠলাম যে কি বলব? বল্লাম : শিগগির আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও বলছি, নমিতা তোমার কে শুনি যে আদিখ্যেতা করবার আর জায়গা পাওনি?”
মুখের কথা কাড়িয়া নিয়া প্রদীপ হাসিয়া কহিল,-“দয়া করে একটু সরু, গাড়িটা যেতে পারছে না।”
নমিতা ধীরে প্রশ্ন করিল : “কতদিন আগে এসেছিলেন?”
-“এই ত’, দিন তিন-চার হবে। ও হরি! তখন কে জান্তো ছোঁড়াটা এত বড় হতচ্ছাড়া, এত বড় জানোয়ার। নমিতাকে নিজে সরিয়ে দিব্যি ন্যাকা সেজে কি না বলে গেল : নমিতার ঠিকানা কি। বলতে পারেন? ব্যাটা পাজিক বচ্ছর হ’ল ওর শুনি?”