—“না, না, কি দেব কোত্থেকে? আপনি ঠিক উপকার করবেন?”
উমার ভাবাকুল দুইটি চোখের দিকে তাকাইয়া ভদ্রলোকটি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন,—“যদি পারি, নিশ্চয় করব। কেন করবো না?”
-“কেন করবেন না, তার কারণ অনেক থাকতে পারে। ফি পাবেন।
যে, কিন্তু সত্যি যদি দীপ-দাকে খালাস করে দিতে পারেন, একদিন নিশ্চয়ই নেমন্তন্ন করে খাওয়াব আপনাকে।” বলিয়া উমা নিজেই। হাসিয়া ফেলিল।
ভদ্রলোক ব্যবসার খাতিরে গম্ভীর হইয়া উঠিলেন : “কে দীপ-দা?”
—“এই মোকদ্দমার আসামী।”
—“আসামী? কেন, তার পক্ষে উকিল নেই?”
—“বোধ হয় না। দীপ-দা আমার এমন লোক নন যে কুৎসিত মিথ্যার বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে নিজেকে কলঙ্কিত করে’ তুলবেন! আমি তাকে চিনি না? বরং তিনি হাসিমুখে মিথ্যার অত্যাচার সইবেন, একটিও সামান্য প্রতিবাদ করবেন না।”
ভদ্রলোকটি ভীষণ অস্থির হইয়া উঠিলেন : “কী হয়েছে আমাকে সব খুলে বলুন দিকি শিগগির, দেখি আমি কী ব্যবস্থা করতে পারি। একটা জামিন পৰ্যন্ত চাওয়া হয় নি?”
উমা কহিল,—“শত্রুতা করে আবার বাবা আর শচীপ্রসাদ বলে। একটা ছেড়া—”
উকিল বাধা দিলেন : “আপনার বাবা! ঐ মহিলাটি আপনার কে হয?”
—“বল্ছি। মহিলাটি আমার বৌদি। সংসারের অত্যাচারে হোল্ক বা যার জন্যেই হোক্, পথে বেরোন, আর পথের মোড় থেকে আমার দীপ-দাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে এক ঘোড়ার গাড়ি করে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সব বুঝে নিন্ শিগগির। তারপর বাবার নালিশে পুলিশ গিয়ে ধরে—পুলিশের কাছে মোমের পুতুল আপনার ঐ মহিলাটিই এখন বলছেন যে দীপ-দা তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাবার ছল করে ইত্যাদি ইত্যাদি।”
—“কিন্তু এসবের প্রমাণ?”
উমা কহিল,—“যদি ভগবানে বিশ্বাস করেন ত’ তিনি।”
—“আচ্ছা, আচ্ছা, আপনার বৌদির বয়স কত?”
উমা বোধকরি চটিয়া উঠিল : “ঐ চেয়ে দেখুন না। বয়েস দিয়ে আপনার কী হবে?”
কোনো কথা বলিবার আগেই ম্যাজিষ্ট্রেট আসিয়া কোর্টে প্রবেশ করিলেন। সবাই উঠিয়া দাঁড়াইল—উদ্বেল জনকোলাহল স্তব্ধ হইয়া। গেল।
এই দীপ-দার চেহারা হইয়াছে। পরনের কাপড়টা ময়লা, চুলগুলি শুক্ননা জট-পাকানো, পায়ে জুতা নাই—কোমরে দড়ি বাধা। কতদিন যেন ঘুমাইতে পারেন নাই, দাড়ি কামান নাই, গায়ের জামাটা পর্যন্ত ছিঁড়িয়া গেছে। এ দিকে একবার তাকাইতেছেন না কেন? তাহার কিসের লজ্জা যে গভীর অনুশোচনায় তাহাকে হেঁট হইয়া দাঁড়াইতে হইবে?
উমা সহসা নিতান্ত অবোধের মত উকিলটির দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া ব্যাকুল অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে কহিল,—“যে করে পারুন, আমার দীপ-দাকে এই কলঙ্ক থেকে বাঁচান্। ফি আপনাকে আমি পরে যেখান থেকে পারি জোগাড় করে দেব। যেখান থেকে পারি—আমার গয়না আছে। বৌদিকে দুটো জেরা করলেই সত্য কথা বেরিয়ে পড়বে। আপনি যদি না পারেন, অন্য কাউকে ডাকুন্। বৌদি সতী সেজে কাঠের ফ্রেমে-আঁটা ছবি পূজো করুন্ ক্ষতি নেই, কিন্তু দীপ-দাকে এমন করে’ মরতে দেবেন না কখনো।”
—“আপনার কিচ্ছু ভয় নেই।” বলিয়া ভদ্রলোক সস্মিত মুখে বেঞ্চি ছাড়িয়া একপাশে সোজা হইয়া পঁড়াইলেন। তাঁহার মুখের ঐ বন্ধুতাপূর্ণ হাসি ও দাঁড়াইবার এই দৃপ্ত ঋজু ভঙ্গিটি উমাকে যে কী আশ্বাস দিল বলা যায় না।
সরকারের পক্ষের কালো গাউন-পরা উকিল খাড়া হইলেন। নমিতা ধীরে ধীরে কাঠগড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার দিকে চাহিয়া উমার দুই চক্ষু ঠিক্রাইয়া পড়িতে লাগিল—নির্লজ্জ, স্বেচ্ছাচারী! নমিতা দাঁড়াইল, কিন্তু তাহার সর্বাঙ্গে দুনমনীয় কাঠিন্য, মুখে নিষ্ঠুর সাহস,ঘোমটার ফাঁক দিয়া বিস্রস্ত বেণীটা নামিয়া আসিয়াছে—যেন সৰ্ববন্ধনহীনতার সঙ্কেত। উমা প্রদীপের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহারে মুগ্ধ দৃষ্টি সেই নিরাভরণা দেহাগ্নিশিখাকে বন্দনা করিতেছে।
সমস্ত ঘর মৃত হৃৎপিণ্ডেব মত স্তব্ধ।
সরকারের পক্ষের উকিল কথা পাড়িলেন—নমিতার নাম ধাম বংশপরিচয় সম্বন্ধে অবান্তর প্রশ্ন। তার পর :
—“তুমি ঐ আসামীকে চেন?”
—“চিনি।”
—“বেশ। ঐ লোক ১৭ই কার্তিক রাত্রি একটার সময় তোমার ঘরে এসেছিলো?”
—“না।”
-“না? তোমাকে এসে বলেনি যে তোমার মা’র মরণাপন্ন অসুখ, তোমাকে এক্ষুনি যেতে হবে?”
—“না। মিথ্যা কথা।”
—“এই বলে তোমাকে ভুলিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে এসে ট্রেনে করে ফুলহাটি গ্রামে নিয়ে যায় নি?”
—“কখনো না।”
অবনীবাবুর মুখে কে কালি মাখিয়া দিল; শচীপ্রসাদ সামনের টেবিলের উপর একটা ঘুসি মারিয়া বলিয়া বসিল : সুপিড। সরকারের পক্ষের উকিল কহিলেন,—“তবে, কী হয়েছিলো খুলে বল।”
নমিতার গলার স্বর একটু কাঁপিল না পৰ্যন্ত। ধীরে সংযত, গভীর কণ্ঠে সে বলিতে লাগিল : “কিছুই বিশেষ হয় নি। আমি স্বেচ্ছায় আপন দায়িত্বে ঘর ছেড়েছি—মুক্তি আমার নিজের সৃষ্টি। প্রদীপবাবু আমার বন্ধু, বিপদের সহায়। তাকে সঙ্গে করে আমার নিজের প্ররোচনায় আমি ফুলহাটি বেড়াতে যাই। এর মধ্যে এতটুকু সঙ্কোচ ছিল না, এতটুকু কলুষ নেই। আমি সাবালিকা, আমার বয়স গত আশ্বিনে কুড়ি পূর্ণ হয়েছে। জীবনের কোথায় আমার গন্তব্য, কে আমার সঙ্গী, কেন আমার যাত্রা—এ সবের বিচার করবার আমার বুদ্ধি হয়েছে। যদি ভুল হয়ে থাকে তার পরিণামও আমিই বিচার করূব। প্রদীপবাবু নির্দোষ, নিষ্কলুষ—আমার মুক্তি আমার নিজের রচনা।”
সবাই একসঙ্গে একেবারে থ হইয়া গেল। ঘরের ছাতটা ভাঙিয়া পড়িলেও বোধ করি শচীপ্রসাদের কাছে এত অস্বস্তিকর লাগিত না। সরকারী উকিল কর্কশ হইয়া কহিলেন,—“তবে পুলিশের কাছে এত সব উল্টো কথা বলেছ কেন?”