উমা প্রতিবাদ করিয়া উঠিল : “এই ত এতক্ষণ কলকাতার কালি আর কলের গুণকীৰ্ত্তন হচ্ছিল। সেখানে আকাশ নেই বলে ত’ আপশোষ করবার আপনার কারণ ঘটেনি। আপনার মতো আমিও না-হয় হাওয়ার বদলে ধোঁয়া খাবো।”
প্রদীপ কহিল, “ধোঁয়া আমার সয়, কিন্তু বিকেল পাঁচটার সময় পেট পুরে ভাত আর কপির ডাটা খেতে হলে সারারাত তোমার চোয়া ঢেকুর উঠবে। ছেলেদের যা সয়, মেয়েদেররা কি তাই সইবে ভেবেছো?”
উমা এইবার রীতিমত চটিয়া উঠিল : “না, সয় না! ছেলেরা সব হনুমান কি-না। সব থার্ড ডিভিশানে পাশ করে।”
“আর মেয়েরা করে ফেল।” “ইস, নিয়ে আসুন ত’ ক্যালেণ্ডার।”
“ক্যালেণ্ডারে বুঝি ফেল-এর সংখ্যা থাকে? তুমি ছেলেদের হনুমান বলে বটে, কিন্তু রামায়ণে হনুমানের মতো বীর আর কি আছে! সেতু বেঁধে দিলে কে?”
“তা’ আর জানি না? নিজের ল্যাজে আগুন ধরিয়ে সমস্ত লঙ্কা পুড়িয়ে দিলে কে? হনুমানের কথা আর বলবেন না। ও একটা প্রথম নম্বরের ইডিয়ট। বিশল্যকরণী আনতে গিয়ে গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাই নিয়ে এল।”
“ইডিয়ট, কিন্তু কি প্রকাণ্ড বীর ভেবে দেখ। কোনো বানরনন্দিনীকে পাঠালে তিনি সমস্ত জীবন ধরে ঐ বিশল্যকরণী-ই খুঁজে বেড়াতেন, লক্ষ্মণ আর বাতো না।”
উমা আরো উদ্দীপ্ত হইয়া কহিল,-“নাই-বা বাঁচত! ঐ দ্বিতীয় ইডিয়ট লক্ষ্মণ—রাম ফল এনে ওর হাতে দিয়ে বলতেন—ধর, আর ও এমন গৰ্দত যে সে ফল ধরে’ই থাকূত, খেত না। এম্নি করে চোদ্দ বছর লোকটা না খেয়ে বেঁচে রইল। যদি রাম বলতেন—মুখে তোল, ও মুখে তুলত বটে, কিন্তু নিশ্চয় চিবোত না; যদি বলতেন—চিবোও, ও কখনো গির্ত না দেখো।”
প্রদীপ আর অরুণা দু’জনেই হাসিয়া উঠিলেন। উমা বলিয়া চলিল,—“আর ইডিয়ট-শ্রেষ্ঠ রাম সামান্য ধোপা-নাপিত বন্ধ হবে ভেবে সোনার সীতাকে বনে পাঠালেন–সেই সীতা, যে তার জন্যে সারাজীবন সন্ন্যাসিনী হয়ে ছিল। আর যেমনি ধোপারা কাপড় কাচতে ও নাপিতরা দাড়ি চাঁছতে রাজি হ’লঅমনি আবার উনি সীতার জন্যে মাতামাতি সুরু করে দিলেন। ধন্যি মেয়ে সীতা—ঐ মাতালটাকে ছেড়ে পাতালে গিয়ে মুখ ঢাকূলে।”
প্রদীপ আমোদ অনুভব করিয়া কহিল,—“তোমার এই সার্টিফিকেট নিয়ে বেচারা বাল্মীকি বাজারে আর তার রামায়ণ কাটাতে পাবেন না।”
“ছেলেদের কথা আর বলবেন না, সব টুকে পাশ করে।”
“টোকবার মতো ট্যাক্ট মেয়েদের নেই বলে’। একটা কথাতেই তফাৎ ধরা যাচ্ছে, উমা। তুমি ছেলে হলে এই একা-একা পরীক্ষাসমুদ্র উত্তীর্ণ হ’বার ভয়ে এত ভড়কাতে না।”
“কাজ নেই আমার হনুমান হ’য়ে।” বলিয়া উমা হঠাৎ গম্ভীর হইয়া গেল; কণ্ঠস্বর আর্ন হইয়া উঠিয়াছে। কহিল,—“দাদা নেই, সমস্ত বাড়ি খাঁ খাঁ করূছে, বৌদি কঁদতে গিয়ে বোবা হয়ে গেছে, মা দিবারাত্রি চোখের জল ফেলেন, বাবা পাগলের মতো পাইচারি করে’ বেড়ান,—আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কলকাতায় আমাদের কেউ আত্মীয় থাকলে আপনার সঙ্গেই চলে যেতাম এবার। আমি যাবোই পড়তে।”
উমা ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছিল, অরুণা ডাকিলেন। উমা ফিরিল। অরুণা কহিলেন,—“বৌমা কোথায়?”
“স্নান করতে গেছে।”
“তোর প্রদীপ-দা আজ চলে যাচ্ছেন, ঠাকুরকে বল কিছু ভালো করে বেঁধে দিতে। বৌমার ঘরে উনুন ধরিয়েছিস?”
“এই যাই।” বলিয়া উমা দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।
ক্ষণকালের জন্য আবহাওয়াটা স্বচ্ছ হইয়া আসিয়াছিল, সহসা আবার গাঢ় মেঘ করিয়া আসিল। সেই মেঘান্ধকার নমিতার দুই নিঃসহায় চক্ষু হইতেই ঝরিয়া পড়িতেছে। এই দৃশ্যে নমিতার আবির্ভাব হইল না বটে, কিন্তু প্রদীপের মনোমুকুরে যাহার ছায়া পড়িল সে হয়ত ঠিক নমিতা নয়, একটি কল্পনাভরণা দুঃখৈশ্বৰ্য্যময়ীর ছবি। কবির কল্পনা উন্নত হইতে-হইতে ইন্দ্রিয়াতীত হইয়া যে মহিমাময়ী নারীমূর্তি পরিগ্রহ করে, ঠিক সেই মুর্তি! তাহাকে নমিতা বল, কিছু ক্ষতি হইবে না।
০৪. মেস-এর ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া
মেস্-এর ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া প্রদীপ উপরে আসিয়া দেখিল, তাহার নামে এক চিঠি আসিয়াছে। ঠিকানায় হাতের লেখা দেখিয়াই পত্র-লেখককে চিনিল এবং সেই জন্যই তৎক্ষণাৎ চিঠিটা খুলিল না। আয়নার কাছে দাঁড়াইয়া শক্ত চিরুনি দিয়া নিজের রুক্ষ চুলগুলি ছিঁড়িতে-ছিঁড়িতে ম্যানেজারের উপর রাগটা প্রশমিত করিতে লাগিল।
এই যুগে ভীষ্মকে হয় ত’ প্রদীপ ক্ষমা করিত না, কিন্তু তাই বলিয়া পৈতৃকসম্পত্তি অটুট রাখিবার জন্য সুধী-র এই পিতৃভক্তিকেও স্বৰ্গারোহণের সোপান বলিয়া সে স্বীকার করিতে পারে নাই। তাই সুধী-র বিবাহে সে ত’ যায়ই নাই, বরং তাহাদের দুইজনে যে উপন্যাসখানি লিখিতে সুরু করিয়াছিল, তাহা ফিরাইয়া দিয়া সুধী-কে লিখিয়াছিল : তোমার বর্তমান মনোভাব নিয়ে তুমি উপন্যাসের চরিত্রগুলির প্রতি সুবিচার করতে পারবে না। অতএব এই খাতাগুলি তুমি ফিরিয়ে নাও। যেটুকুন লেখা হয়েছে তাই একদিন তোমাদের অভ্যস্ত বিরস জীবনযাপনের ফাঁকে তোমার ভাৰ্য্যাকে পড়িয়ে শুনিয়ে ও যথাসময়ে তোমাদের প্রথম শাবকের আবির্ভাবের পরে কালক্রমে যখন তার জন্যে মাতৃস্তন্য অকুলান হয়ে উঠবে, তখন গো-দুগ্ধ তপ্ত করবার জন্যে এই খাতাগুলো ব্যবহার করা। ইতি।
তাহারই উত্তরে এই বুঝি সুধী-র চিঠি আসিল—সাত মাস বাদে। আশ্চর্য্য হইবার কারণ আছে বৈকি। এবং আশ্চর্য হইবার কারণ ঘটিলে কৌতূহল চাপিয়া রাখিতে বেশিক্ষণ চিরুনি চালানো অসম্ভব হইয়া উঠে। অতএব ম্যানেজারের পিতৃকুলকে নরকে পাঠাইয়া প্রদীপ চিঠি খুলিয়া ফেলিল।