উমা ফিরিয়া দাঁড়াইল : “তাই যদি হয় তবে নিজের সতীত্বের ওপর মুখোস্ টানবার জন্যে আরেকজনের মুখে কালি ছিটোতে তোমার বিবেক সায় দেয়?”
উমার মুখের কথা কাড়িয়া নিয়া নমিতা হাসিয়া কহিল,—“আরেকজনের জন্যে যে তোমার ভারি দরদ।”
উমা গাঢ়কণ্ঠে কহিল,—“সে-দরদের এক কণা তোমার থাকলে এমন নির্লজ্জের মত নির্দোষ সেজে সমাজের চোখে সস্তা বাহবা নিতে চাইতে না। কে তোমাকে দীপ-দার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে বলেছিলো?”
—“ভাগ্য, উমাযে-ভাগ্য মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে হিজিবিজি ছবি আঁকে। আমার সঙ্গে আর বেশি তর্ক করো না, লক্ষ্মী—আমি ভারি শ্রান্ত হয়েছি। কাল সারা রাত ঘুমুতে পারি নি।”
হঠাৎ উমা নমিতার পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া কহিল,—“কিন্তু দীপ-দাকে তুমি জেল থেকে বাঁচাবে—আমাকে কথা দাও, বৌদি! তিনি ত’ তোমাকে জোর করে বাবা-মা’র কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন নি, তুমিই বরং পথে বেরিয়ে তাকে কুড়িয়ে পেলে। তুমিই বরং তাকে জখম করলে, তিনি তোমার কোনো ক্ষতিই করেন নি। কপালের সেই ঘা-টা তার কেমন আছে, বৌদি?”
নমিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে উমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কখন তাহার পায়ের উপর উমার হাত দুইটি নামিয়া আসিয়াছে তাহাও লক্ষ্য করিতে ভুলিল না। ধীরে কহিল,—“তিনি আমার কোনো ক্ষতিই করেন নি, এ তুমি কী করে বুঝলে, উমা?”
—“ক্ষতি করেছেন! কী তিনি করতে পারেন শুনি?”
—“যদি বলি উমা, তিনি প্রমত্ত পুরুষত্বের লালসায় আমাকে অধিকার করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে শাসন করা দরকার—”
উমা দাঁড়াইয়া পড়িল : “মিথ্যা কথা।”
নমিতা বলিল,—“মিথ্যা কথা নয়, উমা।”
—“তবু নারীর কাছে তার ক্ষমা আছে;-যে-নারী তাঁকে সঙ্গী হ’তে আহ্বান করে, সে-আহ্বান তিনি যদি নিমন্ত্রণ বলে মনে করেন তার মধ্যে কপটতা কৈ, বৌদি। বেশ, তঁাকে তুমি বর্জন কর, কিন্তু মুক্তির যে-দায়িত্ব তুমি অর্জন করলে সে তোমারই থাক্।”
কথা শুনিয়া নমিতা হাসিয়া ফেলিল। ঠাট্টা করিয়া কহিল, “তাকে ত্যাগ করলেই যে তুমি তার নাগাল পাবে এমন কথা বিশ্বাস হয় না, উমা।”
উমার চক্ষু ভিজিয়া উঠিয়াছিল, প্রাণপণে সে চোখের দৃষ্টিকে প্রখর করিয়া রাখিল, কহিল—“আমি কেন, কোন মেয়েই তার নাগাল পাবে না, বৌদি। এই বিশ্বাসই যদি তোমার হয়ে থাকে, তবে কেনই বা তাকে ত্যাগ করতে যাবে?”
উমা আর দাঁড়াইতে পারিল না; মা’র কথা শুনিয়া মুখ ধুইতে নীচে নামিয়া গেল।
২১. যথাসময়ে মালা উঠিল
যথাসময়ে মালা উঠিল।
উমা অবনীবাবুকে বলিল,—“আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব, বাবা।” অবনীবাবু আকাশ হইতে পড়িলেন : “তুই! তুই আবার কোথায় যাবি?”
“কেন, কোর্টে। যেখানে তোমরা সবাই যাচ্ছ।”
শচীপ্রসাদ আগাইয়া আসিল : “তুমি যাবে মানে? তোমার একটা প্রেসটিজ নেই?”
—“নিশ্চয় আছে। বৌদিও ত’ তাঁর প্রেসটিজ বাঁচাতেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চলেছেন। আমি যাব বা, দীপ-দাকে তার জেলে যাবার আগে একটিবার দেখবো।”
নির্ভীক দুরন্ত মেয়ে। মুখে কিছু বাধে না।
শচীপ্রসাদের সহিল না : “দীপ-দাকে দেখবে? ঐ রাগামাফি, স্কাউণ্ডেটাকে? ওকে দেখলেও ত’ অশুচি হতে হয়।”
—“না হয় অশুচি একটু হ’ব। তারপর আপনাদের মুখের দিকে চেয়েই ত’ আমার সে-পাপ কেটে যাবে। দাঁড়াও ভাই বৌদি একটু, আমি কাপড়টা বদলে আসছি। দু’ মিনিটও লাগবে না—এই হ’ল বলে।”
উমা দ্রুতপদে অন্তর্ধান করিল এবং ফিরিয়া আসিয়া দেখিল নীচে তাহার জন্য কেহই আর বসিয়া নাই। হয় ত’ কাপড় বদলাইয়া আসিতে তাহার দু মিনিটের চেয়ে বেশি সময় লাগিয়াছে—ইহার মধ্যে ঘটা করিয়া চুল আঁচড়াইয়া সেফটিপিন আঁটিয়া জুতা পরিয়া তাহার বাবু না সাজিলে গোটা মহাভারতটা অশুদ্ধ হইয়া যাইত না।
কিন্তু এই বেশে বিছানায় লুটাইয়া অভিমানে ও দুঃখে সে গোঙাইবে —উমা ততটা নির্লজ্জ নয়। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত আছেন— তাহাকে এড়াইতে হইবে। একটিও শব্দ না করিয়া উমা অতি সন্তপণে খোলা দরজা দিয়া বাহির হইয়া পড়িল। একটা ট্যাক্সি লইয়া চীফপ্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে যাইতে কতক্ষণ! .
আদালত লোকে লোকারণ্য, কোন প্রকারে ভিড় ঠেলিয়া উমা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। ম্যাজিষ্ট্রেট তখনো এজলাসে আসেন নাই, সমস্ত ঘরময় একটা চাপা গুঞ্জন চলিতেছে। আসামীর ডকৃটাও শূন্য; ম্যাজিষ্ট্রেট আসিলেই হয় ত’ প্রদীপকে হাজির করানো হইবে।
অবনীবাবুদের লক্ষ্যের বাহিরে উমা একটা বেঞ্চিতে একটু জায়গা করিয়া বসিল।
পাশের ছোরা উকিলটি চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। কথা না কহিয়া থাকিতে পারিলেন না : “ঐ মহিলাটি বুঝি আপনার কেউ হন্?”
উমা তাহার মুখের দিকে পৰ্যন্ত চাহিল না; খালি কহিল,-“না।”
—“কিম্বা আসামী?”
—“তাও না।”
উকিলটি বিস্মিত হইলেন : “তবু এসেছেন?”
—“আপনি এসেছেন কেন? আইন শিখতে না কৌতূহল নিবৃত্ত করতে? আমাদের কৌতূহল হয়, মশাই। মেয়েমানুষ নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শত্রুতা করে একজন নির্দোষ ভদ্রলোককে যদি জেলে। পাঠায়, সে একটা উপন্যাসের মতই থিলি। তাই দেখতে এসেছি।”
উকিলটি কহিলেন,—“আপনার কথায় কৌতূহল যে আরো বেড়ে গেল। কী ব্যাপার, খুলে বলুন। যদি পারি উপকার করব, বিশ্বাস করুন।”
উমা কহিল,—“কতদিন প্রাকৃটিস করছেন?”
-“কেন বলুন ত’?”
—“বলুন, দরকার আছে।”
—“প্রায় দু’ বছর।”
—“মোটে!” উমার মুখ ম্লান হইয়া উঠিল।
ভদ্রলোক হাসিয়া কহিলেন,—“কেন, আপনার কোনো কাজ আছে? বেশ ত’ বত্রিশ বছরের প্র্যাকটিস্করা এক বুড়ো-হাবড়া ধরে নিয়ে আসছি না-হয়।”