নমিতার ঘরের গোড়ায় আসিয়া দেখিল সেখানে ছোটখাটো একটি ভিড় জমিয়া উঠিয়াছে। শচীপ্রসাদ পৰ্যন্ত হাজির। সবাইরই মুখ প্রসন্ন, নমিতার প্রতি কাহারো ভাষায় স্বাভাবিক রূঢ়তা নাই। ব্যাপারটা উমা চট করিয়া আয়ত্ত করিতে পারিল না।
শচীপ্রসাদ হাসিয়া কহিতেছে : “যাক্, ও ছোটলোক গুণ্ডাটা যে গ্রেপ্তার হয়েছে তাই ঢের। একেবারে সেসাস কেস,—ছ’টি বচ্ছর শ্রীঘরে। খবর শুনে ফুর্তিতে আমার চা-ও খাওয়া হ’ল না।’ এই যে উমা, চা করে দাও দিকিন একটু।”
অবনীবাবু ঘরের মধ্যে নমিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “পুলিশের কাছে যে সত্য কথা বলেছ বৌমা, তাতেই তোমার বুদ্ধির তারিফ করছি। ঐ পাজির পা-ঝাড়া স্কাউণ্ডে লটাকে এবার আমি দেখাবো—”
—“নিশ্চয়।” শচীপ্রসাদ সায় দিল : “মেয়েছেলে যতই কেন না বেয়াড়া হোতূ, বাড়ির বাইরে যেতে হলে পুরুষমানুষের হেলপ্ তাদের চাইই। তার ওপর উনি হিন্দু-বিধবা, পুরস্ত্রী। তা ছাড়া, কলকাতায় নয়—একেবারে ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে পিটটান। ও স্কাউণ্ড্রেলটাকে যদি বলেও যে বৌদি ইচ্ছে করে বেরিয়ে এসেছেন, ম্যাজিষ্ট্রেট তা কখনো বিশ্বাস করবেন না।”
অবনীবাবু বলিলেন,—“ও বল্লেই হ’ল? বৌমা ত’ জবানবন্দিতে স্পষ্ট বলেই দিয়েছেন যে প্রদীপই ওকে ছলে-বলে ফুসলিয়ে বাড়ির বা’র করেছে। কোর্টেও তোমাকে সে-কথাই বলতে হবে বৌমা, বুঝেছ?”
নমিতা অল্প একটু হাসিয়া সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল।
—“বাস, তা হলে আর আডিউ ইনফ্লুয়েন্স-এর কথাও উঠতে পাবে না। পুলিশের কাছে ওটুকু না বলে’ এলেই মুস্কিল হ’ত।”
শচীপ্রসাদ কহিল,—“বৌদি আমাদের অত বোকা নন্। মেয়েমানুষদের অমন এক-আধটু ভুল হয়েই থাকে, কিন্তু যারা সেই সব ভুল খুঁচিয়ে তাদের বিপথে চালিয়ে নেয় তাদেরকে ছেড়ে দিতে নেই। ফঁদ পেতে ডাকাতটাকে ধরতে পেরেছেন, তাতে আপনাকে বাহবা দিচ্ছি, বৌদি।”
নমিতা আবার একটু হাসিল; চোখ তুলিল না, কথা কহিল না।
কথা কহিল উমা: “ফাঁদে যদি ডাকাত আজ ধরা না পড়ত তবে যাদুকরীকে আপনারা আর আস্ত রাখতেন না। ইদুর আজ সিংহকে ধরে’ দিতে পেরেছে বলেই ছুটি পেলো—নইলে সে একা ফিরে এলে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন।”
অবনীবাবু ধমক দিয়া উঠিলেন: “যা যা, তোকে আর ফর্-ফর্ করতে হবে না। বৌমাকে শিগগির দুটো বেঁধে দে দিকি, এগারোটায় কোর্টে হাজিরা দিতে হবে।”
শচীপ্রসাদ কহিল,-“আর আমার চা।”
ঘর খালি হইয়া গেলে উমা রুক্ষ হইয়া প্রশ্ন করিল,—“বৌদি, এ তোমার কী নির্লজ্জতা?”
নমিতা চকাইয়া উঠিল। উমার মুখের উপর দুইটি জিজ্ঞাসু চক্ষু তুলিয়া সে চুপ করিয়া রহিল।
—“ফিরে এসেছ তার জন্যে তোমাকে তিরস্কার করি না, কিন্তু নিজের ঠুনকো খ্যাতি বাঁচাবার জন্যে এ তুমি কী করে বসলে?”
—“কী করে’ বস্লাম?” নমিতা দৃঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করিল।
—“টের ন্যাকামি করেছ। কেই বা তোমাকে ঘটা করে বাড়ির বা’র হতে বলেছিলো, আর কেনই বা তুমি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করলে? ও-মুখ লুকোবার জন্যে এ-বাড়ির বাইরে কি আর তোমার জায়গা ছিল না?”
নমিতা ধীরে কহিল,—লুকোবার কথা বোল না, ঠাকুর-ঝি। এ-মুখ দেখাবো বলেই ত’ এ-বাড়িতে ফের ফিরে এসেছি।”
উমা তবুও শান্ত হইল না : “কেন ফিরে এলে? যখন বেরুলে ত’ হার স্বীকার করলে কেন? আবার এসে তুমি হবিষি আর ফোটো-পূজা শুরু করবে? তবে এই অভিনয় করবার কি দরকার ছিল?”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“পুলিশে ধরলে আর কি করা যায় বল।”
—“কি করা যায়? স্পষ্ট কণ্ঠে বলা যায় : আমি নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এসেছি, যাকে তোমরা নারীহর্তা বলে’ ধরতে এসেছ, সে আমার নবজীবনের প্রভু, তাকে আমি ভালোবাসি। বলে না কেন, বৌদি?”
মুখ গম্ভীর করিয়া নমিতা কহিল,—“মিথ্যা কথা বলব কি করে?”
—“ভারি তুমি সত্যবাদী মেয়ে এসেছ। তাই কিনা দীপ-দার সর্বাঙ্গে কালি ছিটোতে তুমি দ্বিধা করলে না। যে-ভদ্রলোক স্নেহ করে’ এক নিরাশ্রয় মেয়েকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য এগিয়ে এলেন, তার মাথায় কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে সত্যের গৌরব করতে তোমার লজ্জা করলো না, বৌদি? এই জঘন্য আত্মরক্ষার চেয়ে আত্মহত্যাও ভালো ছিল।”
নমিতা ক্ষীণ একটু হাসিল; কহিল,—“কা’র সত্য কোন পথে এসে দেখা দেয় তুমি সহসা তা বুঝবে না, উমা। বরং শচীপ্রসাদের জন্যে চা কর গে। সুসংবাদ পেয়ে উত্তেজনায় বেচারার দারুণ তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয়।”
উমা রুখিয়া উঠিল : “কার জন্যে চা করতে হবে সে-পরামর্শ তোমার কাছ থেকে নিতে চাই না। নিজের খেলে মান বাঁচাতে গিয়ে ভীরু অপদার্থের মত তুমি যে আরেকজনকে সমাজের চোখে লাঞ্ছিত করবেএ অত্যাচার আমরা সইবো না। মনে রেখো।”
নমিতা স্নিগ্ধ কণ্ঠে কহিল,—“কী আর করবে বল। আইনের কাছে আবদার খাটে কৈ।”
—“খাটেই না ত’। সত্য বলে যা নিয়ে তুমি আস্ফালন করছ সেই তোমার অসতীত্ব। স্থান তোমার সংসারের সেই বাইরেই। তবু তুমি এত স্বার্থপর হবে যে—ছি!”
দারুণ ঘৃণায় উমার চোখমুখ বিষাক্ত হইয়া উঠিল। বহুক্ষণ কেহ কোন কথা কহিল না; উমা যখন চলিয়া যাইবার জন্য পা বাড়াইয়াছে, নমিতা তাহাকে বাধা দিল : “শোেন। সংসারের প্রাচীরের বাইরে চলে এসে আমারো এ দুটি দিনে কম শিক্ষা হয়নি, উমা। আমি বুঝেছি, তোমাদের ঐ সতীত্ব-বোধটা মানুষের ব্যক্তিত্ব-বিকাশের পক্ষে প্রকাণ্ড একটা বাধা। সে-বাধা আমি খণ্ডন করব—আপন শক্তিতে, আপন স্বাতন্ত্রে।”