—“আছে বৈ কি।” কণ্ঠস্বর হঠাৎ গাঢ় ও আর্দ্র করিয়া প্রদীপ কহিল,—“বল্লেই পারতে আমার ভালোবাসার আকর্ষণে তোমাকে সমস্ত প্রাচীন প্রথা ও শাসনের প্রাচীর থেকে মুক্ত করে’ উদার আকাশের নীচে নিয়ে এসেছি—যেখানে বিস্তৃত জীবন, বিচিত্র তার উৎসব। বল্লেই পারতে, সহজ অধিকারের দাবিতে তোমাকে কামনা করেছিলাম, নমিতা।”
অন্ধকারের মধ্যে নমিতা হাসিয়া উঠিল। কহিল,—“অত কথা পুলিশ বুঝত না যে—”
প্রদীপের মুখে আর কথা আসিল না। চুপ করিয়া একদৃষ্টে বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল।
খানিক পরে নমিতা একেবারে ছেলেমানুষের মত তরল সুরে বলিয়া উঠিল : “কেমন মজা! শেষকালে কি না ফুলিয়ে ঘরের বউকে বার করার জন্যে জেল খাটবেন। অদৃষ্টে দুর্গতি থাকলে এমনিই হয়— হাতীও শেষে কাঁটা ফুটে মারা পড়ে।” হঠাৎ কথার মাঝখানে প্রদীপের অত্যন্ত কাছে সরিয়া আসিয়া কানের কাছে মুখ আনিয়া ক্ষীণ। অনুচ্চকণ্ঠে নমিতা কহিল,—“আরো এমনি মজা যে আপনার হাতে এমন কোনো সম্বলও আজ নেই যে আত্মহত্যা করে’ এ কলঙ্ক থেকে ত্রাণ পেতে পারেন। আপনার বন্ধু এ কথা শুনলে কী ভাববেন বলুন দিকি?”
কথা কয়টা কর্ণকুহরে নিক্ষেপ করিয়াই নমিতা আবার দূরে সরিয়া বসিল। প্রদীপ বলিল,-“বন্ধু কী ভাববেন তা তিনিই ভাবুন। জেলে যদি আমি যাই-ও, তবু মনে এমন কোনো গ্লানি থাকবে না যে, আত্মহত্যার উপকরণ হাতে নেই বলে অনুতাপ করতে হবে। ব্যাখ্যা একটা মনের মধ্যে কখন থেকেই গড়ে উঠেছে—তোমার জন্যেই জেলে গেলাম।”
—“আমার জন্যেই বৈ কি।” নমিতা ইনস্পেক্টারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,-“একজন অসহায় বিধবা-মেয়েকে কৌশল করে’ ঘরের বাইরে এনে তার ওপর পশুর মত উৎপীড়ন করতে চান আপনাকে লোকে জেলে না পাঠিয়ে ফুলচন্দন দিয়ে পূজো কবে, আপনার ফোটো সামনে রেখে নিশান উড়িয়ে মিছিল করবে, না?”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া প্রদীপ কহিল,—“যা খুসি বল। কিন্তু তুমি মনে-মনে ত’ জান আমি পশুও নই, দেবতাও হ’তে চাই না। তোমাকে আমি কামনা করেছিলাম বৈ কি, সে-কামনা কবিতার মতই সুন্দর। তোমাকে পাইনি, পাওয়ার পেছনে যে প্রচুর তপস্যার প্রয়োজন হয় সে শিক্ষাই না-হয় জেলে বসে’ লাভ করা যাবে।”
—“যা যা, আর বক্তৃতা করতে হবে না, এখন ঘুমুন গে।” বলিয়া নমিতা বেঞ্চির কিনারে কাঠের দেয়ালে হেলান্ দিয়া পা দুইটা সামনে একটু প্রসারিত করিয়া শুইবার ভঙ্গি করিল, এবং তাহারই ইঙ্গিতে ইনস্পেক্টর আসামীর হাত ধরিয়া অন্য বেঞ্চিটাতে সরাইয়া আনিলেন।
কলিকাতা পৌঁছিয়া পুলিশ প্রদীপকে থানায় লইয়া গেল এবং নমিতাকে অবনীবাবুর জিম্মায় রাখিয়া বলিয়া দিল যেন ঠিক এগোরোটার সময় তাহাকে চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে হাজির করানো হয়।
তোর বেলা—উমা ছাড়া সবাইরই ঘুম ভাঙিয়াছে। আত্মীয়-পরিজনের শাসন-প্রখর দৃষ্টির সম্মুখে নমিতার মুখ একটুও ম্লান হইল না, তার দৃষ্টিতে না একটু কুণ্ঠা, পদক্ষেপে না একটু জড়তা। চাদরটা গায়ের উপর ভালো করিয়া টানিয়া সে সিড়ি দিয়া সোজা তাহার দোতলার পূজার ঘরের দিকে অগ্রসর হইল। নির্ভীক বীরাঙ্গনা, অটল ঋজু মেরুদণ্ড, আকাশের অরুণ-রশ্মির মত তাহার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হইতে যেন একটা দুঃসহ তেজ বিকীর্ণ হইতেছে। আত্মীয়-পরিজনরা মূঢ়দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, কেহ একটা কথা কহিতে পারিল না, না বা পারিল উহাকে বাধা দিয়া উহার মুখ হইতে এই জঘন্য আচরণের একটা অর্থ বাহির করিতে। অবনী বাবু উৎফুল্ল হইয়া ফোনে শচীপ্রসাদকে প্রদীপের গ্রেপ্তারের সংবাদ দিতে ব্যস্ত হইলেন, আর অরুণা তাড়াতাড়ি উপরে উঠিয়া উমাকে জাগাইয়া কহিলেন,—“ওই শিগগির, দেখবি আয়-পোড়ারমুখি ফিরে এসেছে—”
একলা বিছানায় পশ্চিমের বিধুর দিগন্তলেখাটির মত উমা ঘুমাইয়া ছিল। সুরের মাঝে অনুচ্চারিত বাণীর যে সুষমা, ঘুমন্ত উমার দেহে তেমনি একটি অনির্বচনীয় কান্তি। মায়ের হাতের ঠেলা খাইয়া সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল : “কে ফিরে এসেছে মা? বৌদি? আর, দীপ-দা?”
অরুণা মুখ বিকৃত করিয়া কহিলেন,—“আর দীপ-দা! সে পাজিটা পুলিশের হাতে-হাতে তার হাতকড়া। এবার ঘানি ঘোরাবেন আর কি।”
উমার ঠোঁট দুইটি সহসা পার হইয়া উঠিল : “ঘানি ঘোরাবেন মানে? উনি কি করলেন? যদি কেউ পথ ভুল করে বাইরে বেরিয়ে আসে তবে তাকে আশ্রয় দেওয়া পাপ না মহত্ত্ব? ওঁর মহত্ত্ব স্বীকার করে আমাদেরই বরং উচিত মা, ওঁকে একদিন নেমন্তন্ন করে’ খাইয়ে দেওয়া?”
কোথায় উমা জাগিয়া উঠিয়া মা’র সঙ্গে নিভৃতে একটুখানি। নমিতার চরিত্রালোচনা করিবে, না, একেবারে মোড় ফিরিয়া প্রদীপের প্রশংসায় মুখর হইয়া উঠিল। অরুণা ধমক দিয়া কহিলেন,—“এক ফোটা মেয়ে, তুই তার কী বুঝবি? যা, ওঠ, এখন। খালি পড়ে। পড়ে ঘুমুনো। মুখ ধুয়ে পড়তে বোস এসে।”
উঠিতে হইল। ব্যাপারটার আদ্যোপান্ত তলাইয়া বুঝিতে তাহার আর বাকি নাই। নমিতা নিতান্ত নমিতা বলিয়াই তাহার জীবনে এমন একটা আচরণের উপকারিতা সম্বন্ধে সন্দেহ-সঙ্কুল প্রশ্ন উঠে, উমার জীবনে এমন একটা সমস্যার আবির্ভাব হইতে পারে এমন কথা সে নিজে ভাবিতেই পারে না। ঘর সে ছাড়িবে কি না, এবং ছাড়িলে কোথায় বা কাহার সঙ্গে সে আবার ঘর বাধিবে—এই সব প্রশ্ন তাহার ব্যক্তিগত নির্ধারণের বিষয়। ইহার জন্য পাড়ার পাঁচজনের মুখ চাহিতে হইবে নাকি? উমা হইলে কখনই ফিরিয়া আসিত না, এমন ভাবে হয় ত’ নিজেকে বন্দিনী করিয়া ফেলিত যে দীপ-দাকে তাহার কাছ হইতে সরাইয়া নেয় কাহার সাধ্য!!