তাই রাত্রে শুইবার ঘরের দরজায় খিল দিবার আগেই প্রদীপ ঢুকিয়া পড়িল। কম্পমান দীপশিখায় প্রদীপের এই রূঢ় আবির্ভাবে নমিতা চমকিয়া উঠিল। স্পষ্ট দৃঢ় কণ্ঠে কহিল,-“এ অসময়ে, হঠাৎ?”
মাথার চুলগুলিতে আঙুল চালাইতে চালাইতে প্রদীপ কহিল, “তোমার সঙ্গে আমার পরামর্শ আছে।”
গম্ভীর হইয়া নমিতা কহিল,—“বলুন।”
নমিতার কথাগুলি এমন সংযত ও স্থির যে প্রদীপের সমস্ত ভাবোদ্বেগ কেমন ঘুলাইয়া উঠিল। তবু দৃঢ় করিয়াই কহিল, “আমাদের এমনি করে আর থাকা চলবে না।”
—“কোথায় যেতে হবে?”
—“যেখানেই যাই আমাদের সম্পর্কের একটা স্পষ্ট মীমাংসা দরকার।
নমিতা বিরক্ত হইয়া বলিল,-“যারা সমাজবিধানকে হেয়জ্ঞান করে’ বাইরে চলে এসেছে তাদেব পক্ষে আবার সমাজানুমোদিত সম্পর্কের সার্থকতা কি? অপরাধ যদি সইতে না পারি, সেইটেই আমাদের প্রকাণ্ড অপরাধ।” কিছুক্ষণ থামিয়া থাকিয়া নমিতা জিজ্ঞাসা করিল : “তারপর বলুন।”
প্রদীপ কহিল,—“সোজা স্পষ্ট করেই বলি নমিতা, আমি তোমাকে চাই।”
শান্ত স্বরে নমিতা বলিল,-“কথাটা আমি আগেই শুনেছি। পুনরুক্তির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু অর্থের রূপান্তর দরকার। বেশ ত, আমাকে আপনাদের যোগ্য করে নি, কৰ্ম্মে, সহনশক্তিতে, আত্মোৎসর্গে। এর চেয়ে আমাকে আর বড়ো করে পাওয়ার কিছু মানে আছে কি?”
বলিয়া নমিতা জানালার কাছে সরিয়া আসিল। জানালার বাহিরে নদীর উপরে অন্ধকার তরঙ্গ তুলিয়া পুঞ্জিত হইয়া রহিয়াছে—তাহারই পটভূমিতে নমিতাকে সৰ্ববন্ধচ্যুতা একটি শরীরী শিখার মত মনে হইল। প্রদীপ তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া নমিতার একখানি হাত ধরিয়া ফেলিল; কহিল,-“তোমাকে চাওয়ার একটা কায়িক অর্থ আছে, নমিতা। সে শুধু বিরহে নয়, বিহারে। তোমাকে আমি চাই।”
নমিতা হাত সরাইয়া নিয়া কহিল,—“হাত পেতে চাওয়ার দীনতা আপনাকে লজ্জা দেয় না? পাওয়ার জন্য যদি মূল্য না দেন তবে সে-পাওয়ায় স্বাদ থেকে কৈ?”
প্রদীপ কহিল,—“আমি সবই বুঝি, নমিতা। তবু আজকের এই ক্ষণটিতে মনে হচ্ছে সবার চেয়ে বড় হচ্ছে প্রেম,—দশের চেয়ে বড় হচ্ছে এক। কোনো মূল্যই তোমার পক্ষে পৰ্যাপ্ত নয়, আমাকে তুমি বিশ্বাস কর।” বলিয়া মূঢ়চেতন প্রদীপ নমিতাকে একেবারে বেষ্টন করিয়া ধরিল।
ইহার মধ্যে কোথায় একটু অন্যায় ছিল বলিয়াই হোক্, বা প্রদীপের ব্যবহারে বর্বর বন্যতা ছিল না বলিয়াই হোক্, নমিতার আকস্মিক আঘাতে প্রদীপ একেবারে ছিটকাইয়া পড়িল। নমিতা কহিল, “সমাজদ্রোহীদের এমন সামাজিক ব্যবহার ক্ষমার যোগ্য নয়। আপনি যে এত স্বার্থপর ও নীচ তা স্বপ্নেও ভাবিনি কোনোদিন। জানেন না। আমি বিধবা?”
মাথার সেই ক্ষতস্থানেই বোধ হয় লাগিয়াছিল; তাই প্রদীপ রুখিয়া উঠিল : “আর যাকে মানা, তোমাকে এই সতীত্বের আস্ফালন শোভা পায় না। তুমি যা তুমি তাই। সমাজের হাটে তোমার নারীত্ব। একটা পণ্য মাত্র। কিন্তু কাল সকালে তোমার যেখানে ইচ্ছা তুমি। চলে যেয়ো, তোমার ওপর আমার দায়িত্ব নেই।”
নমিতা খালি একটু হাসিল।
সকালে যাইবার জন্য নমিতা প্রস্তুত হইতেছিল কি না কে জানে, কিন্তু যাওয়া আর হইল না। শেষরাত্রি থাকিতেই পুলিশে আসিয়া বাড়ি ঘিরিয়াছে।
২০. অবনীবাবু সহজে পরাস্ত হইবার লোক নহেন
অবনীবাবু সহজে পরাস্ত হইবার লোক নহেন। বুঝিতে তাহার আর বাকি ছিল না যে নমিতার এই উদ্ধত আচরণের আড়ালে কাহার অঙ্গুলিনির্দেশ ছিল! সেইদিন দুপুর বেলায়ই প্রদীপ চলিয়া গেলে অবনীবাবু যখন বকিয়া-ঝকিয়া নমিতাকে একেবারে নাকাল করিয়া ছাড়িয়াছিলেন, যখন এমন পৰ্যন্ত বলিতে দ্বিধা করেন নাই : ঘরের বার হয়ে যেতে পার না ঐ গুণ্ডাটার সঙ্গে, এখানে বসে’ ঢলাঢলি করে’ আমাদের মুখে আর চুণ-কালি মাখাও কেন? তখন নমিতা নিজেকে আর দমন করিতে না পারিয়া বলিয়া বসিয়াছিল; যাবই ত’ বেরিয়ে। কার সাধ্য আমাকে আটকায়! তাই তোর হইলে অবনীবাবুর মনে আর লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, ঐ প্রদীপের সঙ্গেই ষড়যন্ত্র করিয়া চরিত্রহীন মেয়েটা কুল ডিঙাইয়াছে। এত সহজে প্রদীপকে ছাড়িয়া দিবার পাত্র তিনি নন। ফল যাহাই হোক, ঐ গুণ্ডাটাকে একবার দেখিয়া লইতে হইবে। তিনি পুলিশে খবর দিলেন।
গাড়ি আবার কলিকাতার দিকে গড়াইল। রাত্রিকাল। একই গাড়িতে সকলে উঠিয়াছে—দু-পাশের বেঞ্চি দুইটাতে নমিতা আর প্রদীপ; মাঝেরটাতে পুলিশের কয়েকজন লোক। অপরিমেয় স্তব্ধতা— কাহারো চোখে ঘুম নাই। অনেক পরে প্রদীপ ইনস্পেক্টারকে জিজ্ঞাসা করিল,—“জবানবন্দি ত’ টোকা হয়েছে, ওঁর সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারি?”
ইনস্পেক্টার নমিতার অনুমতি চাহিলেন—সে কিন্তু অতি সহজেই রাজি হইয়া গেল। হাসিয়া কহিল,—“আসুন।”
প্রদীপ ধীরে উঠিয়া আসিল। দূরে বেঞ্চির এক পাশে সরিয়া বসিয়া কহিল,—“জবানবন্দিতে কি বল্লে?”
পুলিশকে শুনাইয়া স্পষ্ট করিয়া নমিতা কহিল,—“সত্য কথাই বলেছি। আপনি আমাকে ছল করে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন আর নিতান্ত নির্লজ্জের মতো দৈহিক বলপ্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। বলেছি বৈ কি।”
প্রদীপ স্তব্ধ হইয়া রহিল। গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে কহিল, “জানতাম তুমি তা বলবে। এর চেয়ে সত্য করে কোনো নারী কোনো গুরুষকে দেখতে শেখেনি। কিন্তু কথাটাকে আরো একটু মার্জিত করে বল্লে না কেন?”
প্রদীপের মুখের দিকে অপলক চোখে চাহিয়া থাকিয়া নমিতা বলিল,-“অমন একটা নিদারুণ কথার আরেকটা মার্জিত সংস্করণ আছে নাকি?”