প্রদীপ খুসি হইয়া উঠিল : “আমাকে নিয়ে তুমি কি করতে চাও বল?”
নমিতার মুখ গম্ভীর; একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “দেখা যাক।”
একটা ষ্টেশনে গাড়ি থামিল। প্রদীপ উঠিয়া পড়িয়া কহিল, “তখন থেকে খালি বাজে কথা বলে চলেছি। তোমার মুখ শুকিয়ে। গেছে একেবারে। দেখি ষ্টেশনে কিছু ফল-টল কিনতে পাই কি না।”
নমিতা বাধা দিয়া কহিল,—“আমার জন্যে অকারণে ব্যস্ত হবেন না। শরীরকে আমি স্বচ্ছন্দে শাসন করতে পারি।
কথায় এমন একটা তেজোদীপ্ত দৃঢ়তা যে প্রদীপের পা দুইটা অচল হইয়া রহিল।
গাড়ি আবার চলিয়াছে।
১৯. ম্লান মেঘনার তীরে
ম্লান মেঘনার তীরে অখ্যাত একটি পল্লীতে প্রদীপের একখানি নির্জন কুটির ছিল। চারিপাশে অজস্র শ্যামলতায় গ্রামবধূব প্রগল্ভ নির্লজ্জতা দেখিয়া নমিতা মনে মনে পরম তৃপ্তি পাইল। এমন একটি উন্মুক্ত অবারিত শান্তির জন্যই তাহার তৃষ্ণার অবধি ছিল না। মাঠের উপর আসিয়া দাঁড়াইলে আকাশের দর্পণে আত্মার ছায়া পড়ে নিজের বিরাট সত্তার সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় ঘটে। এমন একটা মহান মুক্তির স্বাদ হইতে সে এতদিন বঞ্চিত ছিল। মানুষের ভবিষ্যৎ যে কত সুদুরবিস্তৃত, কত বিচিত্রপরিণামময়—নমিতার চারিদিকে যেন এই সুস্পষ্ট সঙ্কেতটি সহসা উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
প্রদীপ কহিল,—“নদীর এ ধারটা একেবারে ফাঁকা; ওধারে কতকগুলো বাগদিপাড়া আছে। তুমি স্বচ্ছন্দে স্নান করে’ এস, আমি পাহারা দিচ্ছি।”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“যদি জলে ভেসে যাই, তবে আপনার পাহারায় কি আর সুফল হবে? তার চেয়ে চলুন, দু’জনে বাগদিপাড়াটা ঘুরে আসি না-হয়।”
প্রদীপ কহিল,—“যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে; কাল সকালে যাওয়া যাবে’খন।”
কথার সুরে যেন শাসনের আভাস আছে। নমিতা একটু। হাসিল মাত্র।
গ্রামেই মথুর দাস প্রদীপের একসঙ্গে ভাই ও ভৃত্য। সে আসিয়া বিছানা-পত্র হাঁড়ি-কুড়ি লোক-জন সমস্ত নিমেষে জোগাড় করিয়া দিল। রাত্রে নমিতার যদি ব্যাধিতে কষ্ট হয়, তবে একটি বিধবা ব্রাহ্মণ-কন্যাকেও সে ডাকিয়া আনিতে পারিবে। প্রদীপ মথুরের বাড়িতেই পাত ফেলিবে যা হোক।
প্রদীপ কথাটা পাড়িল। নমিতা রুখিয়া উঠিল,—“বিধবারা আবার রাত্রে গেলে নাকি? এটা কোন দেশের বিধান?”
প্রদীপ কহিল,—“কিন্তু আজ সারা দিন তুমি এক ফোটা জলও মুখে তোলনি, রাত্রে খেলে তোমার অধৰ্ম্ম হবে না।”
নমিতা স্পষ্ট করিয়া কহিল,—“কিসে আমার ধর্মাধর্ম হবে সে-পাঠ আপনার কাছ থেকে না নিলেও আমার চলবে। মনে রাখবেন, আমি বিধবা, ব্রহ্মচারিণী।”
প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“এই তেজটা এতদুর না এসে শ্বশুরালয়ে দেখালেই ভালো মানাত। ফের নিয়ে যাব সেখানে?”
শেষের কথাটার মধ্যে এমন একটা কদৰ্য্য ঝাঁজ ছিল যে নমিতার সহিল না। সে কহিল,—“কোথায় যেতে হবে না হবে সে-পরামর্শ আপনার না দিলেও চলবে। পারে এসে নৌকো আমি পায়ে ঠেলে জলে তলিয়ে দিতে পারি যে কোনো মুহূর্তে।”
প্রদীপ ব্যঙ্গের সুরে কহিল,—“আর নৌকো যদি ঝড়ের সময় তোমাকে না ডুবিয়ে বরং নিরাপদে পারেই পৌঁছে দেয় তবে তাকে ধন্যবাদ দিয়ো। দয়া করে মনে রেখো তুমি আমার অধীনে, এখানে তোমার এতসব বৈধব্যের আস্ফালন চলবে না।”
নমিতার অধর স্ফুরিত হইয়া উঠিল; কহিল,—“আপনিও দয়া করে মনে রাখবেন আপনার অধীনে আসবার জন্যেই আমি এত আড়ম্বর করি নি। আপনার অধীনতায় বিশেষ মাধুৰ্য কোথাও নেই। এখন যান, যেখানে আপনার কাজ আছে। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।”
প্রদীপ কহিল,—“যথেষ্ট ব্রহ্মচর্য দেখিয়েছ, নমিতা। একজন পুরুষকে ধাওয়া করে এতদূর নিয়ে এসে তারপর তার স্পর্শ থেকে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে নিজের সতীত্ব ফলাচ্ছাে, এর মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই।”
নমিতা চীৎকার করিয়া উঠিল,—“যা, যান, শিগগির এ-ঘর ছেড়ে চলে যান। যা শিগগির।”
ঋজু শীর্ণ দেহ যেন অগ্নিশিখা, বাহুটি বিদ্যুৎবর্তিকার মত প্রসারিত, মুখমণ্ডলে রক্তচ্ছটা। প্রদীপের বলিতে সাহস হইল না : এ ঘর-বাড়ির মালিক আমি, আমাকে ঠেলিয়া ফেলিলেই দূর করা যায় না। এ ঘরে আমার অপ্রতিহত অধিকার, তুমি আমার বন্দিনী; আমাকে ছাড়িয়া যাইবার তোমার পথ কোথায়?
সে নীরবে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
সেই যে নমিতা দুয়ার দিল—পরদিন ভোর না হইলে, আর সে বাহির হইল না। মাঝরাতে প্রদীপ একবার উঠিয়া আসিল সত্য, কিন্তু দুয়ারে করাঘাত করিয়াও কোনো সাড়া মিলে নাই। সমস্ত রাত্রি সে নিদারুণ অনুতাপে বিদ্ধ হইয়াছে। নমিতার মাঝে ত’ সে বিদ্রোহিনী দাহিকা-শক্তিরই উদ্বোধন দেখিতে চাহিয়াছিল, অথচ সে তাহার বশবর্তিনী হইতেছে না বলিয়া তাহার এই আক্ষেপ কেন? কেন যে এই আক্ষেপ সারা রাত্রি না ঘুমাইয়াও সে তাহার কারণ খুঁজিয়া পাইল না।
ভোরবেলা ঘর ছাড়িয়া বাহির হইতেই প্রদীপ দেখিল নদীর পারে ঘাসের উপর পা ছড়াইয়া নমিতা বসিয়া আছে। মাথায় ঘোমটা নাই, খোলা চুলগুলি হাওয়ায় উড়িতেছে। এত তন্ময় যে প্রদীপের পায়ের শব্দ পর্যন্ত সে শুনিতে পারিল না। প্রদীপ কাছে আসিয়া কহিল,—“কালকের দুর্ব্যবহারের জন্যে আমাকে ক্ষমা কর, নমিতা।”
নমিতা অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে তাকাইল। সে-মুখের ও কণ্ঠস্বরের নির্মলতা তাহাকে স্পর্শ করিল। সে হাসিয়া কহিল,—“ও-সব ভণিতা ছেড়ে এখানে একটু বসুন। এমন সুন্দর নদী আমি আর কোথাও দেখিনি।”
প্রদীপ একটু দুরে সরিয়া বসিল : “তোমায় চোখ দিয়ে আমিও এই সৃষ্টিকে নতুন করে দেখতে শিখেছি, নমিতা। এই নদী, তার এই অনর্গল স্রোত, ওপরে অবারিত আকাশ, পারে ছোট একটি নীড় আর দু’টি আত্মা ঘিরে অপরিমেয় নিস্তব্ধতা—মনে হয়, নমিতা, সৃষ্টির আদিম যুগে চলে এসেছি আমরা। তোমার মুখ ও এই অবারিত শান্তি ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কী কামনা থাকতে পারে? সত্যিই