প্রদীপের বিস্ময়ের অবধি নাই : “আমাকে?”
–“এই উন্মুক্ততার স্বপ্ন আমাকে আরেকজন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু আপনার বিদ্রোহ একটা ঝড়ের আকারে আমার ঘরে ঢুকে আমার আরাম ও আলস্য, স্থিরতা ও স্থবিরতা সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দিলে। আপনার আচরণে যতই কেন না একটা অপরিচ্ছন্নতা থাক্, সেঅসহিষ্ণুতার মাঝে শক্তি ছিল, তেজ ছিল। তাই আপনাকেই সঙ্গী করলাম।”
খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নমিতা আবার কহিল,—“আমি যে সমাজের প্রতি কী অমানুষিক বিদ্রোহাচরণ করলাম তা আপনিও বুঝবেন না।”
প্রদীপ অনিমেষ চোখে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।
নমিতা কহিল,-“ঐহিক বা পারত্রিক কোনো লোভের বশবর্তী হ’য়েই এই বিরুদ্ধাচরণ করিনি। লোকে যতই কলঙ্ক দিক্, আমার ভগবান তা শুনবেন না। আর, আমি তারই সঙ্গ নিলাম, যার দুর্ধর্ষ আচরণে সমস্ত সংসারের কাছে আমার মুখ অপমানে ও লজ্জায় কালো হয়ে উঠল।”
–“মানুষের মনোরাজ্যের এমন একটা অস্বাভাবিক বিশৃঙ্খলা আমার কাছেও ভারি অদ্ভুত ঠেছে, নমিতা। যার প্রতি তোমার বিদ্বেষ ও রাগের অন্ত থাকা উচিত নয়, এবং এখনো যার প্রতি তুমি মৌখিক শিষ্টাচারের একটা কৃত্রিম আবরণ মাত্র মেনে চলুছ, তোমার এই দুর্দিনে তাকেই তুমি সাথী নিলে, এটার রহস্য সত্যিই রোমাঞ্চকর, নমিতা।”
নমিতা দৃঢ় হইয়া কহিল,—“না, এটার মাঝে অবাস্তব উপন্যাসের কোনো ইন্দ্রজালই নেই কিন্তু। আমার আচরণটা কোষমুক্ত অসির মতই স্পষ্ট। আপনাকে আগেই বলেছি বেরিয়ে আসাটাই আমার কীৰ্ত্তি, তার নিমিত্তটা অশরীরী। কিন্তু সংসারে আপনাকে নিয়েই আমার দুর্নাম, আপনাকে দিয়েই আমার উৎপীড়ন,—ভাবলাম এমন কীর্তিসঞ্চয়ের দিনে আপনিই আমার উপযুক্ত সহচর। শুধু সমাজ নামে ঐ বধির শাসনস্তুপটা নিজের দাহে নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যাক্, সেই আনন্দেই আপনার সাথী হলাম, আপনার কামনার আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করবার জন্যে নয়।”
মুগ্ধ হইয়া প্রদীপ কহিল,—“এত কথা তুমি শিখলে কোথা থেকে?”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“এ সব ভাবলেশহীন অসার বক্তৃতা নয় যে, বই বা খবরের কাগজ থেকে মুখস্ত করে এসে চেচিয়ে লাফিয়ে সবাইকে চমকে দেব। এ আপন আত্মার কাছ থেকে গভীর করে জানা, আপন অন্তরের খনি খুঁড়ে এ-মণি আবিষ্কার করতে হয়। তাই এশিক্ষা পেতে দিন-ক্ষণ পাজি-পুথি লাগে না, একটি মুহূর্তস্থায়ী বিদ্যুৎ বিকাশে সমস্ত আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আপনাকে বাহন করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমার সমাজকে শাসন করা। তদতিরিক্ত কোনো মূল্য আপনাকে আমি দিতে পারছি না।”
প্রদীপ তাহাকে বিরত করিয়া কহিল,—“মুক্তি তুমিই খালি লাভ করনি, নমিতা, আমিও। তুমি তোমার আচরণের মুক্তি, আমি আমার অন্তরের স্বাধীনতা। আপন আত্মার কাছ থেকে আমিও গভীর করে সত্য শিখে নিলাম, নমিতা, এক মুহূর্তে, চোখের একটি দ্রুত পলক-পতনের আগে। সঙ্কীর্ণ অচলায়তন ছেড়ে আজ আত্মোপলব্ধির পথ পেলাম।”
নমিতা বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। পরে ধীরে কহিল,-“আপনার জীবনের এই সব উত্তেজিত মুহূর্তগুলিকে আমি ভয়ানক সন্দেহ করি। এই অন্ধ উত্তেজনাই হচ্ছে সত্যিকারের ম্রিয়মাণ।”
—“নয়, নয়, তা নয় নমিতা। আমি খালি সংগ্রাম করব এউত্তেজনা যেদিন লাভ করেছিলাম সেদিন আমার কবিত্বের, আমার আত্মবিকাশের সমস্ত বাতায়ন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটা একটা উগ্র নেশা মাত্র ছিল, হোলি-খেলার উৎসব জমাতে গিয়ে হিন্দুস্থানিরা যেমন মদ খায়। সেটাতে সৃষ্টির উত্তেজনা ছিল না, স্নায়ুকে সে সহিষ্ণু করে না, সেতারের তারের মত সঙ্গীতময় করে তোলে না। কিন্তু আমিও যে একদিন রাত্রির আকাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপিন অস্তিত্বের প্রসারতা বোধ করেছিলাম সৃষ্টির প্রেরণায়, সে-সত্য আজ আবার তোমাকে কাছে পেয়ে উদঘাটিত হ’লনমিতা। সমস্ত ভুল আমার ফুল হয়ে বিকশিত হ’ল। আর আমি সৈনিক নই, স্রষ্টা। বুঝলাম, জোর খাটালেই লাভ করা যায় না, তপস্যা চাই। যে-জিনিস সাধ করে হাতে আসে না নমিতা, তার মধ্যে স্বাদ কই?” বলিয়া প্রদীপ হঠাৎ নমিতার দুই হাত চাপিয়া ধরিল।
নমিতা হাত সরাইয়া নিল না। তেমনি উদাসীন নির্লিপ্তের মত কহিল,—“আপনার এমন স্নায়ুদৌর্বল্যের খবর পেয়ে আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই আর আপনাকে ক্ষমা করবেন না।”
প্রদীপ ব্যস্ত হইয়া প্রশ্ন করিল,-“কে? অজয়?”
নমিতা অস্ফুট স্বরে কহিল,-“হাঁ; তিনি আপনাকে ভাববিলাসী, অকর্মণ্য বলে’ ঘৃণা করবেন।”
তাড়াতাড়ি নমিতার হাত ছাড়িয়া দিয়া প্রদীপ উত্তেজিত হইয়া কহিল,-“কেন, পদে পদে আমি ওর প্রতিবিম্ব হয়ে থাকূব আমাকে সৃষ্টি করবার সময় বিধাতা এমন চুক্তি করেছিলেন নাকি? মানুষের বিশ্বাসেরও সীমা থাকা উচিত। তার জন্যে সমস্ত বিশ্বকে সঙ্কীর্ণ করে’ রাখতে হবে আত্মার এমন খৰ্ব্বত। আমি সহ্য করবো না। নতুন সত্যের আলোকে পুরাননাকে পরিষ্কৃত করে নেব না, আমার এমন অন্ধ অনেদাৰ্য নেই। বহু-বৈচিত্র্যের আস্বাদে যে বদলায় না, তাকে আমি জীবন্মত বলি, নমিতা। অজয়ের ক্ষমা না-ক্ষমায় আমার কিছু এসে যায় না। তার সত্য তার, আমার আমার। তার পথ থেকে আমি সরে এলাম। আমি একা, আমি নবীন।”
নমিতার ঠোঁটের কিনাবে সামান্য একটি ধারালো হাসি ফুটিয়া উঠিতেই প্রদীপ কথা থামাইল। নমিতা কহিল,—“বদলানোতে আপনার বাহাদুরি আছে। কিন্তু সে-কথা থাক্। আমাকে নিয়ে এখন কি করতে চান?”