প্রদীপের মুখ দিয়া বিস্ময়সূচক একটা ধ্বনি বাহির হইবার আগেই নমিতা কহিল,—“হাঁ, মিথ্যাচারই ত। সত্যকে পাব ভেবে যে-নিষ্ঠাকে যত মহৎ করেই দেখি না কেন, তার মধ্যে নিত্যের দেখা না পেলেই দারুণ ঘৃণা ধরে যায়। সেই ঘৃণা প্রকাশ করবার দিনের নাগাল আজ পেয়েছি আমি।”
ঘোমটার তলা হইতে বিপর্যস্ত চুলগুলি দুই হাতে তুলিয়া লইয়া নমিতা খোপা বাধিতে বসিল।
গাঢ়স্বরে প্রদীপ কহিল,—“তোমার সান্নিধ্যের মাদকতায় আমি অবিচল থাকবে, আমার ওপর তোমার এ-বিশ্বাস এলো কি করে? তুমি সাবধান করে দিলেই যে আমার স্নায়ুমণ্ডলী মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মত নিস্তেজ হয়ে থাকবে আমার ভালবাসাকে তুমি এতটা হীন ও দুর্বল করে দেখবার সাহস কোথা থেকে পেলে, নমিতা?”
অথচ কথার সুরে মিনতি ঝরিতেছে। নমিতা স্তম্ভিত বিস্ময়ে প্রদীপের মুখের দিকে চাহিল। সে-মুখে সহসা উষাভাসের লাবণ্য আসিয়াছে, নমিতা চোখ ফিরাইতে পারিল না। প্রদীপ আবার কহিল,—“তার চেয়ে তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কিম্বা তোমার যদি আর কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকে, ঠিকানা বল, তোমাকে সেখানে রেখে আসি। আমার সঙ্গে তুমি এসো না। আমি নিষ্ঠুর বলে’ বলছি না, আমি লোভী; আমার রক্ত খালি তপ্ত নয়, পিপাসিত। সমাজের কলঙ্কভাজন হতে আমার অশ্রদ্ধা নেই, কিন্তু তোমার কাছে আমি কালো হতে পারবো না। আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না, নমিতা।”
নমিতা স্থির শান্ত কণ্ঠে কহিল,—“আমি আপনাকে খুব বিশ্বাস করি।”
—“না, আমার ললাভের সীমা নেই, নমিতা। না না, সে তুমি বুঝবে না।”
—“আমি খুব বুঝি।”
—“বোঝ না। তোমাকে পাবার জন্যেই আমি দস্যু সেজেছিলাম। খালি প্রার্থনার মধ্যে পেতে হবে কেন, সংগ্রামের মধ্যেও লাভ করা যায়। তোমাকে আমি কেড়ে ছিনিয়ে নেব এই প্রতিজ্ঞায় আমার হাতের মুঠো দু’টো কঠিন হয়েছিল। কিন্তু তোমাকে কোনোদিন পাব না জানলে এমন পিপাসাকে প্রশ্রয় দিতাম না।”
নমিতা ধীরে কহিল,—“আপনার এ-অস্থিরতা দেখে আমারই ভারি লজ্জা করছে। কোনো মেয়ের কাছে পুরুষের এই নাকি-কান্নার মত বীভৎসতা পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। আপনি যা বলেন বলুন, আমি আপনারই সঙ্গে যাব। যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানে, অপ্রতিবাদে, যে কোনো সৰ্ব্বনাশে। নিন, ধরুন আমার হাত।” বলিয়া নমিতা তাহার আঁচলের তলা হইতে একটি শুভ্র শীৰ্ণ হাত বাড়াইয়া দিল।
প্রদীপ তাহা ছুইতেও পারিল না। যেন আগামী জন্মে চলিয়া আসিয়াছে এমনই একটা অভাবনীয়ের চেতনায় সে খানিকক্ষণ বিমূঢ় হইয়া রহিল। সেই অতটুকু নমিতা এত শীঘ্র এমন করিয়া বলাইল
কিসে? তাহার মেরুদণ্ড কয়েকদিনেই কঠিন দুর্নমনীয় হইয়া উঠিয়াছে। হাত বাড়াইয়া দিবার ভঙ্গিটিতে কী তেজস্বিতা! এত নিভৃতে নিকটে রহিয়াও তাহার স্বাতন্ত্রের মৰ্যাদাটুকুকে সে সন্দেহে দুৰ্বল, আশঙ্কায় নিষ্প্রভ করিয়া তুলে নাই। হাসিয়া কহিল,—“আপনি ত’ আমার বন্ধু, দেখি, আপনার হাত দিন।”
প্রদীপ একটিও কথা কহিতে পারিল না, আস্তে তাহার হাতখানি অসীম ভীরুতায় প্রসারিত করিয়া দিল। নমিতা তাহা স্পর্শ করিয়াই ছাড়িয়া দিল না; কহিল,—“এক দিনেই আমার জন্মদিন আবার ঘুরে এল, এবং এ-জন্ম মনে হচ্ছে পৃথিবীতে নয়, আকাশে। আপনার লোভকে আমি ভয় করব ভাবছেন? কেন, আমি জয় করতে পারি না?” একটুখানি হাসিয়া আবার কহিল,—“আপনার লোভ আছে, আমার দুর্গম দুর্গ নেই? আপনি আক্রমণ করতে পারেন আর আমি আত্মরক্ষা করতে পারি না?”
না, পার না—প্রদীপ ইচ্ছা করিলেই ত’ ঐ তপঃশীর্ণা দেহলতাকে তাহার বুকের উপর দলিত করিয়া ফেলিতে পারে। ঐ ভুরু, নাক, ঠোঁট —আভরণহীন দু’খানি রিক্ত বাহু,—সমস্ত কিছু সে অজস্র অজস্র চুম্বনে সোনা করিয়া দিবে। কিন্তু নমিতার চারিদিকে এমন একটা অব্যাহত কাঠিন্য, এত কাছে বসিয়াও চতুর্দিকে সে একটা দুরতিক্রম্য দূরত্ব বিস্তার করিয়া আছে যে, প্রদীপ একটি আঙুলও নাড়িতে পারিল না। নমিতা কহিল,-“তা হলে আপনি যে ঘটা করে’ অতসব বক্তৃতা দিয়ে এলেন তা শুধু আমাকেই লাভ করতে, আমাকে মুক্ত করতে নয়?”
প্রদীপ হাত সরাইয়া নিয়া কহিল,—“তার মানে?”
—“তার মানে, আপনার সঙ্গে আমার যদি আইনানুমোদনে বিধবাবিবাহ হত, তা হলে স্বচ্ছন্দে আবার আমাকে দাসী বানিয়ে ফেলতেন। অর্থাৎ, আমি যদি কোনোদিন কোনো ছুতোয় খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারি, বিশ্রামের জন্য আবার যেন আপনারই শাখায় এসে বসি—এই আপনার কামনা ছিল?”
প্রদীপ কহিল,—“ছিল, নমিতা। কিন্তু অমন রূঢ় উপমা প্রয়োগ করো না। একদিন এই সব নিষ্ফল পূজোপচার দু’হাতে ছড়িয়ে দিয়ে তুমি ব্যক্তিত্ব-পূজায় বরণীয় হয়ে উঠবে এই কামনা করে তোমার জন্য আমি একটি প্রতীক্ষার বাতি জ্বেলে রেখেছিলাম। যে অসীম-শূন্যচারী পাখী চলার বেগে খালি চলে, থামে না, তার বেগের মাঝে একটা ক্লান্তির কদৰ্যতা আছে।”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“এও আপনার রূঢ় উপমা। জানেনই ত’ বড় বড় কথা আমি বুঝি না। দুর্বোধ্য হবার জন্যেই যেসব কথা বড় বলে’ বড়াই করে সেগুলোকে আমার অত্যন্ত বাজে মনে হয়।”
দুই জনে আবার চুপ করিয়া গেল। দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠের শেষে অবনত আকাশের অজস্র প্রসারের পানে চাহিতে-চাহিতে নমিতার দুই চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। আবার অসঙ্কোচে ভাবগগদ স্বরে কহিল, —“কী সঙ্কীর্ণ সংসার থেকে এই প্রচণ্ড পৃথিবীতে এসে উত্তীর্ণ হলাম, তার জন্যে আপনাকে আমার বহু ধন্যবাদ।