ভোর বেলা দুইজনে চিটাগং-মেইলে চাপিয়া বসিল।
তুচ্ছ দেশ, তুচ্ছ সমাজ-সংস্কার! এতদিন সে বৃথাই অজয়ের সঙ্গে পল্লীর পঙ্কোদ্ধার-ব্রতে মত্ত ছিল। মাইলের পর মাইল হাঁটিয়া চাঁদা কুড়াইয়া গ্রামে স্কুল বসাইয়াছে, এবং সে-স্কুল উঠিয়া গেলে দুই বন্ধু স্বচ্ছন্দে সরিয়া পড়িয়াছে। একটা বঞ্চিত ব্যর্থ বিকৃত জীবনের বোঝ। কাঁধে লইয়া সে এতদিন দেশ হইতে দেশান্তরে ঘুরিয়া মরিতেছিল কেন? নমিতার স্পর্শে তাহার আজ মুক্তিমান হইল। পুরোনো দিনের সেই খোলস তাহার এক নিশ্বাসে খসিয়া পড়িয়াছে, সে আজ কবি, আনন্দ-উদধি! সে নিজেকে সুন্দর করিবে; পৃথিবীকে সমৃদ্ধ, স্বপ্নরঞ্জিত! আজ তাহার নূতন করিয়া জন্মলাভ হইল,-নমিতা সেই বিস্মৃত অতীতের তীর হইতে একটি শুত সঙ্কেত লইয়া তাহার জীবনে আবিভূত হইয়াছে—প্রেমে, মঙ্গলাচরণে, কায়িককল্পনায়।
গাড়িটা নির্জন ছিল—একই বার্থে দুই জানালায় দুই জন ষ্টেশনের দিকে মুখ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কিন্তু কিছু একটা কথা না বলিলে এই স্তব্ধতা অতিমাত্রায় কুৎসিত ও দুঃসহ হইয়া উঠিবে। কিন্তু কী-ই বা বলিবার ছিল! নমিতা মুখাবয়ব এমন দৃঢ় করিয়া রাখিয়াছে, দুই চোখে তার এমন কঠিন ঔদাসীন্য, বসিবার ভঙ্গিটিতে এমন একটা দৃপ্ততা যে, কোমল করিয়া তাহার নামোচ্চারণটি পর্যন্ত প্রদীপের মুখে আর মানাইবে না। অথচ এমন একটি স্নিগ্ধ-করোজ্জ্বল প্রভাতের জন্য তাহার প্রার্থনার আর অন্ত ছিল না। সেই দিনটি এমন মৃত্যু-মলিন রাত্রির মুখোদ পরিয়া দেখা দিল কেন?
গাড়ি ছাড়িবার দেরি ছিল। প্রদীপ কহিল,—“তোমাকে একটা বই কিম্বা পত্রিকা কিনে এনে দেব?”
নমিতা অনুদ্বিগ্ন স্পষ্টতায় উত্তর দিল : “ইংরেজি বর্ণমালার পরস্পর সন্নিবেশের কোন মাহাত্ম্যই আমার কাছে নেই। আপনি আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না।”
শেষের কথাটুকুর প্রখরতা প্রদীপের কানে বাজিল : “কিন্তু সারা পথ। তুমি এমনি বোবা হয়ে বসে থাকবে?”
নমিতা চোখ ফিরাইল না, একাগ্র দৃষ্টিতে প্ল্যাটফর্মের উপরকার জনপ্রবাহের দিকে চাহিয়া কহিল,—“কথা বলবার লোক থাকলেই চলে না, কথা চাই। কিন্তু আমার জীবনে আবার কথা কী! সব কথা ফুরিয়ে গেছে।”
—“কিন্তু আমার অনেক কথা ছিলো।” —“কিছু দরকার নেই।”
প্রদীপ এক মুহূর্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল। পরে কহিল,—“কোথায়। যাচ্ছ জানতে তোমার একটুও কৌতূহল হচ্ছে না, নমিতা?”
নমিতা এইবার প্রদীপের মুখের দিকে দুই চক্ষু তুলিয়া ধরিল। সেই চক্ষু দুইটি অপ্রত্যাশিতের আশঙ্কায় স্তিমিত নয়, ভাবাবেশে গভীর নয়, উলঙ্গ তরবারির মত প্রখর। তাহার ঠোঁটের প্রান্তে মুমূর্য শশিলেখার মত একটি বিবর্ণ হাসি ভাসিয়া উঠিল। কহিল,—“যাচ্ছি যে সেইটেই বড়ো কথা, কোথায় যাচ্ছি সেইটে নিতান্ত অবান্তর।”
গাড়ি এতক্ষণে ছাড়িল। রাশীকৃত কোলাহল ক্রমে ক্রমে টুকরাটুকরা হইয়া এখানে সেখানে ছিটকাইয়া পড়িতে লাগিল। গাড়ি এখন মাঠের মাঝে আসিয়া পড়িয়াছে। প্রদীপ কহিল,—“কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে ত’ ঠাই নিতে হবে।”
নমিতার স্বরে সেই অনুত্তেজিত ঔদাস্য : “কিন্তু পৃথিবীতে কোনো জায়গাই মানুষের পক্ষে শেষ আশ্রয় নয়। পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গেসঙ্গে জায়গাও বদলে যায়। তাই জায়গা সম্বন্ধে আমার কৌতূহলও নেই, আশঙ্কাও নেই। আমি সকল আশা-আশঙ্কার বাইরে। সেই আমার ভরসা।”
প্রদীপ কাছে সরিয়া আসিল : “তুমি এ-সব কী বলছ, নমিতা?”
নমিতা একটুও ব্যস্ত হইল না : “বলছি, আপনি যে-জায়গায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন সেখান থেকে ফের সরে পড়তে আমার দ্বিধা থাকবে না। আসবার যাবার দু’দিকের পথই আমার জন্য খোলা আছে। বুঝেছেন?”
জিজ্ঞাসাটুকুর মধ্যে শ্লেষ আছে। প্রদীপও ব্যঙ্গ করিয়া কহিল, “কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকেই অবলম্বন করে আশ্রয় খুঁজতে বেরুলে; এটার মধ্যেও ত’ দ্বিধা থাকা উচিত ছিল।”
—“উচিত অনেক কিছুই ত’ ছিল। উচিত ছিল স্বামী না মরা, উচিত ছিল স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে যৌবন উবে যাওয়া। তার জন্যে আমার ভাবনা নেই। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমার আর অনুশোচনা হয় না। আপনার সঙ্গে কেন বেরুলুম সেটা আপনিই ভেবে দেখুন না একবার।”
প্রদীপ কহিল,—“আমার ভেবে দেখাতে ত’ কিছু এসে যাবে না। কিন্তু পাঁচ জনের মুখের দিকে ঘোমটা তুলে চাইতে পারবে ত’, নমিতা?”
—“আপনার সঙ্গে কেন বেরুলুম সেইটে আপনি ভাল করে ভেবে। দেখেন নি বলে’ই পাঁচজনকে টেনে এনে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আমি ত’ আর আপনার জন্যে বেরিয়ে আসিনি।”
ম্লান হাসিয়া প্রদীপ বলিল,-“সে-কথা মুখ ফুটে না বললেও আমি ঠিক বুঝেছিলাম, নমিতা। আমার জন্যেই যদি বেরিয়ে আসতে, তা হলে তোমার তপস্যার তাপে পাঁচ জনের তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব ঘটতে। তখন তুমি আপন সত্যে স্থির, আপন অধিকারে প্রতিষ্ঠিত থাকতে। আমার জন্যেও বেরুলে না, অথচ আমারই সঙ্গ নিলে, তোমার বাড়ির অভিভাবকরা এর সূক্ষ্ম রসটা আবিষ্কার করতে পারবে কি?”
নমিতা চোখের দৃষ্টিকে কুটিল করিয়া কহিল,—“বাড়ির অভিভাবকের রসবোধের অপেক্ষা রেখে ঘর ছাড়িনি—একথা ভুলে গিয়ে আমার চরিত্রের ওপর কটাক্ষ করবেন না। তারা বুঝুন না বুঝুন, আপনি বুঝলেই যথেষ্ট। রাত একটার সময় সদর দরজা খুলে গুটিসুটি বেরিয়ে এসে পথের মাঝখানে আপনারই হাত ধরলাম, সংবাদটার মধ্যে যথেষ্ট মাদকতা আছে। সে-মাদকতায় আপনিই যাতে আচ্ছন্ন না হন সেই বিষয়ে আপনাকে সাবধান করে দেওয়া দরকার। কোনো দুর্বল মুহূর্তেই যেন এ ভেবে গর্ব অনুভব না করেন যে, আমি আপনার ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়েই আপনার বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আমি বেরিয়েছি নিজের প্রেরণায়, নিজের দায়িত্বে—আপনি আমার পক্ষে একটা উপকরণ মাত্র, লক্ষ্য নয়। দয়া করে এ কথা মনে রেখে চলবেন আশা করি।” বলিয়া নমিতা একটা ঢোঁক গিলিল। তাহার উত্তেজনা এখনো শান্ত হয় নাই। জিত, দিয়া ঠোঁট দুইটা ভিজাইয়া আবার সে কহিল,—“আমার স্বামীর ফোটোটা আপনি ভেঙে দিয়ে এসে। আমার বিপ্লবের সমস্ত মাহাত্ম্য নষ্ট করে দিয়েছেন। ভেবেছিলাম আমিই একদিন ওটাকে ভেঙে-চুরে ছিড়ে-ছিড়ে কুটি-কুটি করে’ ফেব। মিথ্যাচারকে আর কত দিন প্রশ্রয় দেওয়া চলে?”