নমিতার এতগুলি কথার মধ্যে একটি কথামাত্র প্রদীপ কুড়াইয়া লইল : “আমার সঙ্গে সায় দিতে হবে তোমার এমন কোনো চুক্তি আছে নাকি, নমিতা?”
—“না থেকে আর উপায় কি? আপনার সঙ্গেই যখন যেতে হচ্ছে।”
—“আমার সঙ্গে যাবার জন্যে ত’ তোমার দিক থেকে কোনো আয়োজনই হয় নি, নমিতা। আমি তোমার সঙ্গে আছি এ তোমার জীবনের আকস্মিক একটা দুর্ঘটনা মাত্র। তুমি ত’ আর সত্যি আমার জন্যেই পথে নাম নি।”
নমিতা কহিল,—“তা ত’ নয়ই। সে-কথা বার বার বললে মানে উলটে যাবে না কখনই। আমি একলাই বেরুতুম, কিন্তু পুরুষ একজন সঙ্গে থাকলে কিছুটা আমার সুবিধে হবে ভেবেই আপনাকে চিঠি লিখেছি। আপনি আমার পথের অবলম্বন মাত্র, বিশ্রামের আশ্রয় নয়। সত্যভাষণের দীপ্তি যদি সইতে না পারেন, তবে নেমে যান গাড়ি থেকে, আমার আপত্তি নেই। যে-দেবতা আমাকে ডাক দিলেন, রাখতে হয় তিনিই আমাকে রাখবেন। মিছিমিছি আপনাকে ব্যস্ত করলুম হয় ত’।”
নমিতা জানার উপরে বাহুর মাঝে মুখ লুকাইল।
প্রদীপ কহিল, “তোমার মাঝে আমি মুক্তির মহিমা দেখছি, নমিতা—”
নমিতা মুখ না তুলিয়াই কহিল,—“এটা কবিত্ব করবার সময় নয়।”
—“জানি। নানা রকম বিপদের সঙ্গে আমাদের বুঝতে হবে, নানারকম সমস্যা। সমাজ, আইন, হৃদয়। সে-সবের মীমাংসা অহিংসামূলকই করে তুলব আমরা। দাঁড়াও, কথা আমাকে শেষ করতে দাও। তোমার চিঠি পেয়ে এ-কথা যদি একবার ভেবে থাকি যে, বেরুলেই তুমি আমার হৃদয়ের নিকটবর্তী হবে সেটা নেহাৎই আমার অন্ধতা। দুটো দেহের স্থানিক সান্নিধ্যই মিলন নয়, নমিতা। সেলুব্ধতা আমার ছিল কি ছিল না তেমন বিচার আগে থেকে করতে গিয়ে তুমি আমোক লাঞ্ছিত হ’য়ো না। ধরে’ নাও আমি তোমার বন্ধু। তবে এখন বলতে তোমার দ্বিধা করা উচিত নয়—কেন তুমি এমন বিস্ময়কর কাজ করে ফেললে?”
নমিতা মুখ তুলিল। অন্ধকারেও স্পষ্ট মনে হইল সে কঁদিতেছে। চাদরের খুঁটে চোখ মুছিয়া সে কহিল,—“বিস্মিত আমিও নিজে কম হইনি, প্রদীপবাবু। কিন্তু বেরিয়ে না এসে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে বসে’ থাকবার মত অমানুষিক সতীত্ব আমার সইলো না। কুরুসতায় দ্রৌপদীও এতদূর লাঞ্ছিত হয়েছিলেন কি না মহাভারত লেখে না। আমার এতদিনকার স্বামিধ্যান কৃচ্ছ্বপালন সমস্তই আমার বৈধব্যের মতই নিস্ফল হ’ল। ভাবলুম, আপনার সেই হৃদয়হীন দস্যুতাই যখন আমার সকল অত্যাচারের মূল, তখন দায়িত্বও আপনারই। তাই আপনাকে চিঠি লিখলুম। যত বড় অমানুষই হোন না কেন, একজন ভদ্রনারীর করুণ আবেদন হয় ত’ অগ্রাহ্য না-ও করতে পারতেন। তবু যদি রাস্তায় এসে আপনাকে না পেতুম, আমাকে সামনেই চলতে হ’ত, এগোবার সময় ফেরবার সমস্ত গতি নিবৃত্ত করেই বেরিয়েছি।” বলিয়া নমিতা ঝর ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
প্রদীপ কহিল,—“হৃদয়হীন সত্যিই আমি ছিলাম না, নমিতা। তবু যদি সন্দেহ কর এই বিদ্রোহাচরণে কোনো কল্যাণ নেই, তবে বল, গাড়ি ফিরতে বলি।”
কান্নার মধ্যেই কর্কশ স্বরে নমিতা কহিল,–“না।”
প্রদীপ কহিল,—“দায়িত্ব আমারই। ভেবেছিলাম, যাকে চাওয়া যায় তাকে পাওয়া যায় না, এ নিয়ম ঈশ্বরের মতই অবধারিত। কিন্তু জোর করে’ যদি তাকে ছিনিয়ে নেওয়া যায় তবেও ত’ তাকেই পাওয়া হ’ল। স্তরভেদের সূক্ষ্মতাবিচার ভুলে গিয়েছিলাম, নমিতা। ভুল হয় ত’ আমার ভেঙেছে, কিন্তু সময় যদি একদিন আসে, বুঝবে, সত্যিই আমি হৃদয়হীন ছিলাম না। আমি তোমাকে পাই না পাই, সংসারব্যাপারে এ একটা অতি তুচ্ছ কথা। তুমি তোমাকে পাও এই খালি প্রার্থনা করি। কিন্তু যাক্, গাড়িটা ষ্টেশনে ঢুকছে। বাকি রাতটা প্ল্যাটফর্মেই কাটাতে হবে। ভোর বেলা ট্রেনে চাব।”
ট্রেনে চাপিয়া কোথায় যাইবে এমন একটা কৌতূহলী প্রশ্নও নমিতার মুখ দিয়া বাহির হইল না। তাহার মুখ আবার সহসা রুক্ষ ও বিকৃত হইয়া উঠিয়াছে। মুখের প্রত্যেকটি রেখা একটা আত্মঘাতী প্রতিজ্ঞার সঙ্গে প্রদীপের প্রতি বীভৎস ঘৃণায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে কহিল,—“দায়িত্ব থেকে আপনাকে আমি মুক্তি দিলুম—স্বচ্ছন্দে, অতি সহজে। আপনি বাড়ি ফিরে যান। প্ল্যাটফর্মে বা কোথায়। রাত কাটাতে হবে সে-পরামর্শ আমার চাইনে।” বলিয়া নিজেই গাড়ি হইতে নামিয়া আসিয়া গাড়োয়ানকে প্রশ্ন করিল,-“তোমাকে কত দিতে হবে?”
আঁচলের গেরো হইতে পয়সা বাহির করিতে আর হাত উঠিল না, গাড়ির ভিতরে হঠাৎ প্রদীপের আত্তকণ্ঠ শুনিয়া সে জালা দিয়া চাহিয়া দেখিল, তাহার মাথার ব্যাণ্ডেজটা মুখের উপর নামিয়া আসিয়াছে এবং কপালের যে-জায়গাটা কাটিয়া গিয়াছিল সেই ক্ষতস্থান হইতে নূতন করিয়া রক্ত ঝরিয়া প্রদীপের জামা-কাপড় ভাসাইয়া দিতেছে। উদ্বিগ্ন হইয়া নমিতা কহিল,—“ঈস! কি করে খুলে গেল ব্যাণ্ডেজ? আসুন, আসুন, নেমে আসুন শিগগির।”
প্রদীপ নড়িল না। নমিত। আবার গাড়িতেই উঠিয়া বসিল। বলিল,-“ঈস! এতটা কেটে গিয়েছিল নাকি? দাঁড়ান, চুপ করে’ থাকুন, আমি বেঁধে দিচ্ছি।”
-“এখানে হবে না। চল, নামি।” বলিয়া প্রদীপ নমিতার বাহুতে ভর দিয়া নামিয়া আসিল।
—“ভাড়াটা আমিই দিচ্ছি।” প্রদীপ ব্যাগ খুলিল।
গাড়োয়ান চলিয়া গেলে প্রদীপ বলিল,-“ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ভাল করে বেঁধে দাও, নমিতা।”
নমিতা বলিল,-“শুয়ে পড়ুন। কেমন করে’ খুললেন?”
প্রদীপ কপালে নমিতার আঙুল ক’টির স্পর্শ অনুভব করিতে করিতে বলিল,-“কেমন আপনা থেকে খুলে গেল, নমিতা।”