প্রদীপ কহিল,—“আমার আর থাকা চলবে না, মা। এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু দেখে, এই অসহায় কাকুতি শুনে আমি ভারি দুর্বল হয়ে পড়েছি, মনে আমার অবসাদ এসেছে। এই বৈরাগ্য আমার জীবনের পক্ষে উপকারী হবে না। এর থেকে আমি ছাড়া পেতে চাই।” বলিয়া প্রদীপ অরুণার লাবণ্যমণ্ডিত মুখের পানে চাহিল।
“এখন কোথায় যাবে, কলকাতায়? কলকাতায় তোমার কে আছে? য্যাদ্দিন থেকে গেলে অথচ তোমার কোনো খোজই নেওয়া হ’ল না।”
প্রদীপ কহিল,—“খোঁজ নেওয়ায় বিপদ আছে, মা। খোঁজ যদি পেলে, তবেই ত’ বেঁধে রাখবার জন্যে হাত বাড়াবে; এই অবাধ্য বুনো ছেলেটাকে কেউ বাঁধতে পারেনি। বাঁধতে যাবে, অথচ হারাবে, সেই দুঃখ আর সেধে নিতে চেয়ো না, মা। আমি আবার আস্বাে।”
এই ছেলেটির প্রতি অরুণার মাতৃস্নেহ উথলিয়া উঠিল, সুধী যেন প্রদীপকে প্রতিনিধি রাখিয়া গিয়াছে। অরুণা কহিলেন,-“এমন কথা কেন বলছে প্রদীপ, স্নেহের বাঁধন কি এত সহজেই হেঁড়া যায়? তুমি কি ভাবছে তোমাকে আমরা ভুলে যাবো?”
প্রদীপ কি বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় উমা আসিয়া হাজির। উমা সুধী-র ছোট বোন, ম্লান ললিতত মেয়েটি, মৃদু-মৃগস্বভাব;—এই ষোলয় পা দিয়াছে। উমাকে দেখিয়াই অরুণা কহিলেন,—“তোর প্রদীপদা চলে যাচ্ছেন।”
উমা কহিল,-“আজই?”
প্রদীপ উত্তর দিল,—“আজই, উমা। কত কাজ কলকাতায়। আমাকে য়্যাদিন না দেখে ট্রাম বাস নিশ্চয়ই স্ট্রাই করে বসে আছে, রাস্তায় আলো জ্বলছে না।”
উমা হাসিয়া কহিল,—“রাস্তায় আলো জ্বলাবার চাকরিটা আপনার জন্যে পড়ে আছে! যাচ্ছিলেন ত’ কাশ্মীর, য়্যাদ্দিনে কি তার মেয়াদ ফুরিয়ে যেত?”
“কাশ্মীর-ই বল বা কাশী-ই বল, কলকাতার ডাক দু সপ্তাহের বেশি উপেক্ষা করা যায় না। সুধী-র সঙ্গে সেই চুক্তি করেই বেরুচ্ছিলাম, কিন্তু মৃত্যুর পরে যদি কোনো আদালত থাকে মা, সুধী-র বিরুদ্ধে সেই চুক্তিভঙ্গের মামলা আমাকে আনতেই হবে। এ-কালে সৌন্দৰ্য্য যদি কোথাও থাকে উমা, তা হলে কলেই আছে।”
বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু মেলিয়া উমা কহিল,—“কলহেও।”
প্রদীপ বলিয়া চলিল,—“তাই ত’ কলকাতা এমন করে আমার মন ভুলিয়েছে। আকাশের রোদন শুনে বেদ রচিত হয়েছিল পুরাকালে, এ-কালে আমরা যন্ত্রের যন্ত্রণা শুনে আবার মহাকাব্যের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি। মাঠের চেয়ে শহর সুন্দর, মঠের চেয়ে ফ্যাক্টরি-প্রান্তরের চেয়ে প্রাচীর। প্রকৃতিকে কলকাতা যে বিকৃত করে তুলেছে, আমার তা’তে ভারি ভালো লাগে।”
উমা বিস্মিত হইয়া কহিল,—“বলেন কি? প্রকৃতিকে আপনার ভালো লাগে না?”
প্রদীপের স্বর কিঞ্চিৎ দীপ্ত হইয়া উঠিল : “একটুও না। তুমি কলকাতায় গিয়ে মধ্যরাত্রে একবার ডালহৌসি স্কোয়ারের পারে দাঁড়িয়ো। সব ট্রাফিক্ বন্ধ, ঘন কালো রাত্রি নেমে এসেছে, চারপাশে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দালান,—স্থির, নিরুত্তর, অভ্রভেদী—ওপরে তারকা-দীপ্ত বিস্তীর্ণ আকাশ। ভাব দেখি, কী কৃত্রিম, এবং কী করুণ!”
সমস্ত ছবিটি যেন উমার চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল। সুধী-র কাছে উমা অনেক কিছু পড়াশুনা করিয়াছে; তাই ইহার পর বলিতে পারিল : “এই প্রকৃতির পূজা করেই কত কবি চিরকালের জন্য নাম করেছেন। ধরুন ওয়ার্ডসোয়ার্থ।”
প্রদীপ একটুখানি হাসিল, কহিল,—“যদিও তার wordsএর কোনো worth নেই। ভাগ্যিস জন্মেছিলেন কাম্বারূল্যাণ্ড-এ, ছবির মত সবুজ গাঁয়ে—তাই প্রকৃতিকে নিয়ে এমন কেলেঙ্কারিটা তিনি কবুলেন। জন্মাতেন এসে সাহারায়, কিম্বা গ্রীষ্মকালের মধ্যভারতে, লু-তে লুণ্ঠিত হ’তেন, তবে বুঝতেন মজা। ঝড়ে যার নৌকোডুবি হয় উমা, সে বর্ষা নিয়ে আর কবিতা লেখে না।”
উমা বলিল,-“আপনি এবার কলকাতায় গিয়ে বেথুন-বোর্ভিঙে আমার জন্যে একটা সিট রাখবার চেষ্টা করবেন, বুঝলেন?”
অরুণা হাসিয়া কহিলেন,—“এই হয়েছে। ওর মাথা এবার বিগড়ালো।”
উমা চটিয়া কহিল,—“মাথা বিগড়ালে কি? দাদার সঙ্গে-সঙ্গে আমার পড়াশুনোও চুলোয় যাক্, না? কলকাতায় ত’ এবার লোক্যাল গার্ডিয়ান্ পেলাম, গিয়ে গিয়ে দেখা করবেন ত’?”
প্রদীপ কহিল,—“সময় হয়ত করে নিতে পারূববা, কিন্তু কলকাতা গিয়ে তোমারই সময়টা বৃথা অপচয় হবে। তার চেয়ে আর একটা। বছর এখেনে এই শালবনের তীরে বসেই বইগুলোর সঙ্গে শুভদৃষ্টি করূতে থাক—ম্যাটিটা তুমি তাতেই উৎরে যাবে। তারপর না-হয়। কলেজে গিয়ে কলি ফিরিয়ো।”
উমা কহিল,—“আমার বেলায় বুঝি শালবনের টনিক প্রেস্ক্রাইবড, হ’ল! লক্ষটা শাল গজা, কিন্তু এখানে একা বসে থাকলে লক্ষ বছরেও আমার ম্যাট্রিক পাশ হবে না।”
প্রদীপ হাসিয়া বলিল,—“তাতে বরং ভালোই হবে—মাঝখান থেকে তোমার লক্ষ বছর বাঁচা হয়ে যাবে।”
অরুণা চিন্তিত হইয়া বলিলেন,—“একবার যখন গোঁ ধরেছে, সহজে ছাড়বে ভেবেছ?”
“আমি এক্ষুনি বাবার মত নিয়ে আসছি।” বলিয়া উমা ছুটিয়া বাহির হইতেই প্রদীপ তাহাকে ডাকিয়া বাধা দিল; কহিল,—“কলকাতায় মেয়ে-ইস্কুলের বোর্ডিংগুলোর কথা ত’ আর জান না, তাই অমন খেপে উঠেছ। ওখানে মেয়েদের খেতে দেয় না, তা জান? বিকেল পাঁচটার সময় ভাত খাইয়ে সমস্ত রাত উপোস করিয়ে রাখে, ঝি-দের সুবিধে করূতে গিয়ে ঝিয়ারিদের শুকিয়ে মারে। ও জুজু-মাসির বাড়ি যেতে। নেই, উমা। খালি দেয়াল আর কাঠ,-একঘেয়ে কাঠিন্য, জুলুম। হাওয়া নেই, এই শালতরুমৰ্ম্মর সেখানে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, আকাশের অর্থ সেখানে মহাশূন্য!”