ক্লান্তস্বরে প্রদীপ কহিল,—“কিন্তু কোথায়ই বা যাবে?”
—“বাঃ, সে ত’ আপনি জানেন। আমাকে আপনি কোথায় নিয়ে যাবেন তার আমি কী জানি?”
প্ৰদীপ ম্লান চক্ষু দুইটি নমিতার মুখের উপর নিবদ্ধ করিয়া কহিল, “সত্যি, কোথায় যাব তার আমি কিছু জানি না।”
নমিতা চঞ্চল হইয়া উঠিল : “কিছুই জানেন না? এখন এ-কথা বলতে আপনার লজ্জা করে না? তখন ঘটা করে আমার ঘরে গিয়ে যাত্রা-দলের ভীমের পার্ট করে এসে এখন শকুনি সাজলে চলবে কেন? চলুন, এগোই। এখানে দাঁড়িয়ে গবেষণা করবার সময় নেই। খানিক বাদেই বাড়িতে তুফান লেগে যাবে। তখন মরবাররা আর মুখ থাকবে না। চলুন।” বলিয়া নমিতাই বড় রাস্তা ধরিয়া আগাইতে লাগিল।
পিছে পিছে দুই পা চলিতে চলিতে প্রদীপ কহিল,—“আমাকে ক্ষমা কর, নমিতা। তুমি বাড়িতেই ফিরে যাও।”
নমিতা ফিরিয়া দাঁড়াইল। সামনেই গ্যাম্পােসটটা, তাহার আলোতে সে-মুখের সব ক’টা রেখা নিমেষে দৃঢ় ও দৃপ্ত হইয়া উঠিল : “আপনি এত বড় কাপুরুষ? বাড়ির বাইরে টেনে এনে আবার তাকে বাড়িমুখো হবার পরামর্শ দেন কোন লজ্জায়? আর, ফেরবার পথ অত সহজ নয়। কিন্তু ঐ দেখুন, একটা গাড়ি যাচ্ছে। বোধ হয় খালি—ডাকুন না, দেখা যাক্।”
গাড়িতে উঠিলে গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল,—“কোথায় যাব?”,
প্রদীপ নমিতাকে প্রশ্ন করিল,—“কোথায় যেতে বলব ওকে? তোমার বাপের বাড়ি?”
—“বাপের বাড়ি! আপনাকে সঙ্গে নিয়ে এত রাত্রে ওখানে ফিরে গেলে বাপের বাড়ির এয়োরা সব বরণডালা নিয়ে আসবে না। কোথায় যেতে বলবেন আমি কি জানি?”
এক মুহূর্ত কি ভাবিয়া প্রদীপ বলিল,—“চল শেয়ালদা।”
দুই জনে মুখোমুখি বসিয়াছে। নমিতা জালা দিয়া রাস্তার উপরে চলমান গাড়ির ছায়াটাই বোধ করি লক্ষ্য করিতেছিল, প্রদীপ একেবারে মূঢ়, স্পন্দহীন। শেয়ালদা হইতেই যে কোথায় যাওয়া যাইতে পারে তাহার কোনো কিনারাই সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। এসময় অজয়ের দেখা পাইলে মন্দ হইত না। সে সমস্ত সমস্যাই খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করিতে পারে, হয় ত’ ভোর হইলেই সে নমিতাকে নিয়া একটা প্রকাণ্ড শশাভাযাত্রার আয়োজন করিয়া ফেলিত। কিন্তু নমিতা যদি আসিলই, তবে রূঢ় কোলাহলে সে যেন নিজেকে ব্যয় না করে, আকাশের দর্পণে সে তার আত্মার প্রতিবিম্ব দেখুকু।
প্রদীপ অনেকক্ষণ পরে কথা কহিল,—“তুমি এমন করে হঠাৎ বেরিয়ে পড়বে, এ ভাবতেও পারিনি, নমিতা।”
নমিতা জানলা হইতে মুখ ফিরাইল না, কহিল,—“তবে কি ভাবতে পেরেছিলেন শুনি?”
একটু দম নিয়া প্রদীপ কহিল,—“ভেবেছিলাম মেরুদণ্ডের অভাবে চিরকাল তোমাকে সমাজের অচলায়তনে কুকড়েই থাকতে হবে।”
নমিতা ভিতরে মুখ আনিয়া ঠাট্টা করিয়া কহিল,-“এখন আমার মেরুদণ্ডটা বুঝি আপনার কাছে প্রকাণ্ড দণ্ড হয়ে উঠেছে, তাই আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে বলছেন। কিন্তু আমার জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না।” বলিয়া আবার সে জানালার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিল।
প্রদীপ কহিল,—“সংসারে কার জন্য কা’র ভাবনা করতে হয় কিছু লেখা থাকে না, নমিতা। তুমি আমার সঙ্গেই ত’ চলেছ। এ-যাত্রায় পৃথক্ ফল যখন কোনদিক থেকেই নেই, তখন ভাবনার অংশটা আমাকেও ত’ খানিকটা নিতে হবে।”
নমিতা সোজা হইয়া বসিল। ঘোমটার তলা হইতে কতকগুলি রুক্ষ চুর্ণকুন্তল মুখের উপর শুইয়া পড়িয়াছে। সে দুইটি ঠোঁট ঈষৎ চাপিয়া কি-একটা কঠিন কথা সংযত করিয়া নিল। পরে স্পষ্ট করিয়া কহিল,—“আপনার সঙ্গে চলছি বটে, কিন্তু আপনার জন্যেই বেরিয়ে আসিনি, দয়া করে তা মনে রাখবেন।”
ম্লান একটু হাসিয়া প্রদীপ কহিল,—“সে-কথা আমাকে মনে না করিয়ে দিলেও চলত, নমিতা। বেরিয়ে যে এসেছ এইটেই আজকের রাতের পক্ষে সত্য, কিসের জন্য এসেছ সেইটে অবান্তর। আমার জন্য বেরিয়ে আসবে এমন একটা অন্যায্য অভিলাষের কলুষে তোমার এ বিজয়গৰ্ব্বকে আমি ছোট করতে চাইনে। কিন্তু এ যখন তোমার একারই দায়িত্ব তখন আমাকে আর গাড়ি করে কোথায় টেনে নিয়ে চলেছ?”
নমিতা চোখের সম্মুখে বিপদ দেখিল। প্রদীপকে এত সহজে মোহমুক্ত করাটা ঠিক হয় নাই। সে হাসিয়া কহিল,—“আমি টেনে নিয়ে চলেছি মানে? আজকে সকালবেলা আমার পূজোর ঘরে কে ঘটোৎকচবধের পালা শেষ করে এলো? বক্তৃতায় পটু, কাজে কপট— এমন লোক দেশের কল্যাণ সাধন করবার অহঙ্কার করে কোন হিসাবে? কোনো রমণীকে কুলের বার করে এনে মাঝপথে তাকে ফেলে চলে যাওয়াটা বীরধৰ্ম্ম নয়। আপনি যেখানে যাবেন আমাকেও সেখানেই যেতে হবে।”
প্রদীপ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। এক রাতে সেই নিৰ্বাককুণ্ঠিতা নমিতা মুখরভাষিণী হইয়া উঠিয়াছে। চোখে চটুলতা, কথায় বিদ্রুপ, ব্যবহারে পরম সাহস। তাহার সেই ধ্যানময় প্রেমগরিমা কোথায় অন্তর্হিত হইল! সেই তেজোদীপ্ত দৃঢ়তার বদলে এ কিসের তরলচাপল্য! তাহার বিদ্রোহাচরণে এমন একটা অপরিচ্ছন্নতা থাকিবে ইহা প্রদীপ কোনদিন বিশ্বাস করে নাই।
প্রদীপ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল,—“আমি ত’ মৃত্যু-অভিসারিক।”
নমিতা হাসিয়া বলিল,—“কবির ভাষায় আমিও তা হলে মৃত্যু স্বয়ংবরা।”
প্রদীপ গম্ভীর হইয়া কহিল,—“সত্যিই আমি মৃত্যুকে জীবনের মূল্য-নির্ধারক বলে স্বীকার করি না। আমি বাঁচতে চাই, পরিপূর্ণ ও প্রচুর করে’ বাঁচা।”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“এ আপনারই যোগ্য বটে। বিসংবাদী মনোভাব নিয়েই আপনি কারবার করেন দেখছি। একবার বলেন : বেরোও; বেরুলে বলেন : ফের। মন খারাপ হ’লে বলেন : মরব; মরবার সময় এলে গল্পের কাঠুরের মত বলেন : বাঁচাও। আমার উপায় নেই, আপনার কথায় সায় আমাকে দিতেই হবে। আপনি যদি বাঁচান, ত বাচব বৈ কি। বাঁচতে চাই বলেই ত’ বেরিয়ে এলুম। মরলুম আর কৈ!”