—“হ্যাঁ, তোর। সব। গরদ তসর সিল্ক মট্কা মসলিন আপাকা —সব।”
রিক্সয় চাপিয়া প্রদীপ কহিল –“চল কাশিপুর।”
রিক্স-ওয়ালা অবাক হইয়া কহিল,—“সে কি বাবু? সে ত’ বহুদূর।”
—“আচ্ছা, আচ্ছা, উল্টোমুখো করে’ নে গাড়িটা। ভবানীপুর চল।”
—“সে ও ত’ ঢের দূর বাবু।”
-“তবে কি সাবু খেয়ে গাড়ি টানিস? নে, হেদোয় যেতে পারবি?”
ডাণ্ডা তুলিয়া ঘণ্টা বাজাইয়া রিক্স-ওয়ালা টানিতে লাগিল।
প্রদীপ কহিল,–“বেশি মেহনৎ হলে আরেকটাতে চাপিয়ে দিস মনে করে। বুঝলি?”
১৮. একটা বাজিবার বহু আগে
একটা বাজিবার বহু আগে হইতেই প্রদীপ গলির মোড়ে প্রতীক্ষা করিতেছে। চিঠি পাইবার পর অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল, তবু এখনো যেন সে ভালো করিয়া কিছুই ধারণা করিতে পারিতেছে না। যে নির্মম ঘৃণায় আঘাত করিতে পারে, সেই আবার কালবিলম্ব না করিয়া সহযাত্রিণী হয় এমন একটা চেতনায় প্রদীপ একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। মানুষের মনে এমন কি পারস্পরিক বৃত্তিবৈষম্য ঘটিতে পারে, ভাবিয়া প্রদীপের বিস্ময়ের আর অন্ত ছিল না। ভয়ও করিতেছিল না এমন নয়। যতক্ষণ নমিতা শ্বশুরালয়ে স্থাণুর মত অচল হইয়া বসিয়া ছিল ততক্ষণ তাহাকে সংস্কার ও বুদ্ধি দিয়া আয়ত্ত করা যাইত, কিন্তু যখন সে সেই পরিচিত ঘর-বাড়ি ছাড়িয়া একেবারে কূলপ্লাবিনী নদীর মত নামিয়া আসিল তখন তাহাকে যেন আর সীমার মধ্যে খণ্ডিত ও লাঞ্ছিত করিয়া দেখিবার উপায় নাই। কোথায় একটা অস্বাভাবিক অসামঞ্জস্যের বেসুর বাজিতেছে, অথচ এমন একটা খবরুদ্র বিদ্রোহাচরণের মাঝেই ত’ সে তাহাকে আহ্বান করিয়াছিল! কিন্তু এমন আকস্মিকতার সঙ্গে হয় ত’ নয়। এই নিদারুণ অসহিষ্ণুতার মাঝে সেন কুশ্রী নির্লজ্জতা আছে। যে-বিদ্রোহ আযোপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তাহাতে সুষমা কোথায়?
অজয় হইলে হয় ত’ লাফাইয়া উঠিত,নমিতাকে সঙ্গে নিয়া হয় ত’ তখনই গলবস্ত্র হইয়া সমাজের উদ্যত খড়ের নীচে মাথা পাতিত! কিন্তু প্রদীপ নমিতাকে পরিপূর্ণ ও প্রগলভ জীবননাৎসবের মাঝখানেই নিমন্ত্রণ করিতে চাহিয়াছে। নমিতাকে নিয়া তাহার তৃপ্তির তপস্যা, সৃষ্টির সমারোহ। সে তাহাকে নিয়া মরণের হলি খেলিতে চাহে নাই। কিন্তু যে-প্রেম দীর্ঘ প্রতীক্ষার অশ্রুসিঞ্চনে সঞ্জীবিত হইল না, সে-প্রেম শরীরের একটা স্নায়বিক উত্তেজনা মাত্র, তাহার কোথায় বা লাবণ্য, কী-বা তার ঐশ্বৰ্য্য! সাহসিকা অভিসারিকার চেয়ে একটি সাশ্রলেখাননা বাতায়নবর্তিনী বন্দিনী মেয়ের মাঝে হয় ত’ বেশি মাধুরী। কিন্তু এখন ইহা নিয়া অনুতাপ করিবার কোন অর্থ নাই। কেন যে সে কী আঘাত পাইয়া হঠাৎ উজ্জ্বল ঝড়ের আকারে নমিতা গিয়াছিল, কেনই বা যে নমিতা সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করিয়াও পুনরায় পরাভূত হইল—ইহার কারণ নির্ণয় করিবারও সময় ফুরাইয়াছে।
রিক্স ছাড়িয়া নানা অলি-গলিতে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া প্রদীপ অত্যন্ত শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। স্নায়ুগুলি শিথিল হইয়া আসিতেই সে নমিতার এই অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবের মধ্যে আর মাদকতার স্বাদ পাইল না’। তবু এখন রাস্তার মাঝখানে নমিতাকে একলা ফেলিয়া সরিয়া পড়িবার মার্জনা নাই। যখন পথে একবার পা দিয়াছে তখন তাহার পার খুঁজিয়া দেখিতে হইবে।
রাস্তা ক্রমে-ক্রমে পাতলা হইয়া আসিল। রাত্রির কলিকাতার স্তব্ধতার মাঝে উন্মুক্ততাব একটা প্রাণান্তকর বিশালতা আছে—এত বড় মুক্তির কথা ভাবিয়া প্রদীপের হাঁপ ধরিল। গলির মোড় হইতে অবনী বাবুর বাড়ির একটা হলদে দেয়াল অস্পষ্টাকারে চোখে পড়ে, তাহারই দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া প্রদীপ চক্ষুকে ক্ষয় করিয়া ফেলিতে লাগিল। এ কী—নমিতাই ত’, সমস্ত গায়ে চাদর মুড়িয়া এদিকে অগ্রসর হইতেছে। আশ্চৰ্য, তাহা হইলে চিঠিটার মধ্যে এতটুকু অসত্য ছিল না? নমিতা তাহা হইলে নিতান্তই কলঙ্কের ডালা মাথায় লইয়া কূল ডিঙাইল! সে প্রদীপকে এতখানি বিশ্বাস করে! সে একবারো কি এই কথা ভাবে নাই যে, যে অমিতচারী উচ্ছঙ্খলস্বভাব প্রদীপ অন্তঃপুরে ঢুকিয়া নির্লজ্জ ও কদর্য্য অভিনয় করিয়া আসিতে পারে, তাহার বিশ্বাস ঘাতক হইতেও দেরি লাগে না? কে জানে হয় ত’ সে এই কথাই ভাবিয়াছিল : তাহার উপর যাহার এমন দুর্দমনীয় লুব্ধতা, সে নিশ্চয়ই এমন সোনার সুযোগ সহজে ফসকাইতে দিবে না, দুই লোলুপ বাহু মেলিয়া গলির মোড়ে ঠিক দাঁড়াইয়া থাকিবে। হয় ত’ সে প্রদীপের আগ্রহকে এমনি একটা কদৰ্থ করিয়া নিশ্চিন্ত ছিল। পরস্পাপহরণই কি তাহার ব্যবসা নাকি? নমিতা তাহাকে কেন সন্দেহ করিল না? কে জানে, নমিতার না আসিলেই বুঝি ভালো হইত। একটা চিঠি লিখিয়া তাহার প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন না করিলে হয় ত’ তাহার স্বর্গচ্যুতি ঘটিত না।
নমিতা সরাসরি প্রদীপের সম্মুখে হাঁটিয়া আসিল; কহিল, “কোথায় নিয়ে যাবেন, চলুন। গাড়ি ঠিক রেখেছেন?”
প্রদীপ ভালো করিয়া নমিতার মুখেব দিকে চাহিতে পারিতেছিল, তবু ক্ষণিক দৃষ্টিপতে যেটুকু আভাস পাইল তাহাতে সে স্পষ্ট বুঝিল যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে-মুখ নিদারুণ বলাইয়া গিয়াছে। দিনের বেলাকার সেই প্রশান্ত ও গাম্ভীৰ্য্যগদগদ মুখোনি এখন নিরানন্দ শুষ্কতায় কুটিল ও কৃশ হইয়া গিয়াছে। কথায় পৰ্যন্ত সেই কুণ্ঠিত মাধুর্যের কণা নাই। সে আমতা আমতা করিয়া কহিল,—“গাড়ি-টাড়ি ঠিক নেই।”
নমিতা সামান্য বিদ্রুপ করিয়া কহিল,—“ভাবছিলেন বুঝি চিঠিতে আপনাকে একটা ধোকা দিয়েছি। মিথ্যা কথা সহজে আমি বলি না। চলুন, গাড়ি একটা পাওয়া যাবে হয় ত’।”