নিশ্বাস বন্ধ করিয়া প্রদীপ চিঠিটা পড়িয়া গেল :
প্রদীপবাবু,
এ-সংসারে আমার আর স্থান নেই। আত্মহত্যা করতে পারতাম বটে, কিন্তু মরুতে আমার ভয় করে। আর, এক মা ছিলেন, তিনিও বিমুখ হয়েছেন। এখন আপনি মাত্র আমার সহায়। এ বাড়ির বৌ হয়ে অবধি কোনদিন পথে বেরইনি, একা বেরুতে আমার পা কাঁপছে। আপনি আজ রাত্রি ঠিক একটার সময় আমাদের গলির মোড়ে অপেক্ষা করবেন—আমি এক-কাপড়ে বেরিয়ে আসব। তারপর আপনি আমাকে যেখানে নেবেন সেখানে যেতে আমি আর দ্বিধা করব। না। ইতি।
–নমিতা
যদু জল লইয়া আসিয়াছে; এক ঢোঁকে সবটা গিলিয়া ফেলিয়াও সে ঠাণ্ডা হইল না। যদুর হাতটা চাপিয়া কহিল,—“ঠিক বলছি, পিওন দিয়ে গেছে? গায়ে খাকির জামা, মাথায় পাগড়ি, পায়ে ফেটি বাধা। ঠিক বলছিস?”
যদু অপ্রস্তুত হইয়া কহিল,—“মিথ্যে বলে আমার লাত কি বাবু?”
—“না না, তুই মিথ্যে বলবি কেন? তুই কি তেমন ছেলে? তুই লক্ষ্মী, আর-জন্মে তুই আমার ভাই ছিলি। তোকে আমি আমার সব দিয়ে দিলাম।”
হাত ছাড়াইয়া নিয়া যদু কহিল,—“কী বলছেন বাবু? সামান্য একটা চিঠি এনে দিয়েছি—তাতে—”
-“তুই তার কিছু বুঝবি নে। লেখাপড়া তো কোনোদিন কিছু শিখলিনে, পরের বাড়িতে খালি বাসনই মাজলি। তুই যে একটি রত্ন, এ-কথা তুই নিজেই ভুলে আছিস। হ্যাঁ, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? এই সব—সব তোর। আর, আমার এমন কিছুই নেই যে তোকে দেওয়ার মত দিতে পারি। ঠিক বলছিস? পায়ে ফেটি বাঁধা, মাথায় পাগড়ি, গায়ে খাকির জামা—ঠিক? তুই যখন দেখেছি তখন ঠিক না হয়ে পারে? তুই কি আর আমার সঙ্গে চালাকি করবি?”
যদু ‘ছি’ বলিয়া জিভ কাটিল।
প্রদীপ অস্থির হইয়া উঠিয়াছে : “সব তোকে দিলাম। সব তোর। নিতে হবে। কিছুই আর আমার দরকার নেই। সে ভারি মজা,
এই বিছানা-বালিশ বাক্স-প্যারা জামা-কাপড়—সামান্য যা-কিছু মানুষের লাগে—এক-এক সময় একেবারে লাগে না। কিছু দিয়েই কিছু হয় না। হ্যাঁ, তুই বিশ্বাস করছিস না বুঝি? এ আর এমন কি রাজ্য তোকে দিচ্ছি যে প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে আছিস। বোকাটা!”
যদু আমতা আমতা করিয়া কহিল,—“আপনার তা হলে কি করে’ চলবে?”
—“আমার চলবে না রে পাগলা, চলবে না। আমার আবার আর চলাচলি কিসের? হ্যাঁ, আরেকটা কাজ তোকে করে দিতে হবে ভাই।”
-“বলুন।”
—“মোড় থেকে একটা রিক্স নিয়ে আয় দিকি, একটু বেড়াতে বেরুব।”
—“আপনার যে জ্বর। পড়ে গিয়ে মাথা যে আপনার ফেটে গেছে।”
-“দেখছি না চেহারাটা ভালুকের মত, জ্বরও ভালুকের। কখন যে আসে, কখন যে নেমে যায় ঠাহর করা যায় না।”
প্রদীপের গলার উপরে যদু স্বচ্ছন্দে হাত রাখিল। ভীত হইয়া কহিল,—“গা যে পুড়ে যাচ্ছে।”
প্রদীপ ঠাট্টা করিয়া বলিল,-“ওটা তোর হাতের দোষ। যা, রিক্স্ আন একটা। জলদি।”
—“বাইরে যে হিম পড়ছে বাবু।”
—“দুত্তোর হিম। বেশ ত ঠাণ্ডায় আবার জ্বর জুড়িয়ে যাবে ‘খন। কোনোদিন ত’ আর লেখাপড়া শিখলিনে, কিসে করে যে কী হয় তোর চোদ্দপুরুষও বুঝে উঠতে পারবে না। যা। তোকে গালাগাল দিলাম না ওটা! কী মূখের পাল্লায়ই যে পড়েছি! বেশ জোয়ান দেখে রিক্স আনবি। হা হা—জোয়ান রিস্।”
যদু চলিয়া গেলে প্রদীপ আবার নতুন সমস্যায় পড়িল। টাকা কোথায়? পকেটের বাইরে ও ভেতরে দুই দিকেই সমান দুইটা শূন্য। তবে? অবিনাশের কাছে গিয়া সাহায্য চাহিবে? এখন সে কলিকাতায় না কালিঘাট-এ তাহারই বা ঠিকানা কি? হ্যাঁ, যখন সে সব ছাড়িয়াছে, তখন তাহার টাকাও লাগিবে না। পাগল! সে একা নয়, সঙ্গে নমিতা। সে-কথা সে ভুলিয়া গেল নাকি? না না, ভুলিতে সে মরিতে গিয়াছিল বটে, কিন্তু এখন মরিলেও সে ভুলিতে পারিত না। কিন্তু টাকা চাই। টাকার জন্য কোথায় সে প্রার্থী হইবে আজ? নমিতা মধ্যরাত্রিতে গলির মোড়টা একেলা আসিয়াই ঘুরিয়া যাইবে নাকি? বিশ্বাসঘাতক, প্রদীপ, চরিত্রহীন পাপিষ্ঠ। কুলনারীকে বাড়ির বাহির করিয়া সে আরামে বিছানায় শুইয়া জ্বর ভোগ করিতেছে। ছি! কিন্তু নমিতা নিশ্চয়ই সেমিজের তলায় টাকা নিয়া আসিবে। আনুক, তবু তার কাছ থেকে খরচ চাহিলে তাহার পুরুষগৰ্ব্ব ধূলায় লুষ্ঠিত হইবে যে। হোক, যে সহচারিণী বন্ধু, তার কাছ থেকে এটুকু সাহায্য নিলে লজ্জা কোথায়? নমিতা কোথায় টাকা পাইবে? গায়ে তাহার একখানা গয়না পর্যন্ত নাই। সে-সব অবনীবাবুর সিন্দুকে নিৰ্বাপিত মৃৎপ্রদীপের মত ঘুমাইয়া আছে। নমিতা সে-সিন্দুকের শক্তি কি করিয়া পরীক্ষা করিবে? না, না, টাকা চাই। কোনো দ্বিধা নাই, টাকা তাহাকে সংগ্রহ করিতেই হইবে।
কি ভাবিয়া প্রদীপ দরজায় খিল দিল। একটা লোহার শলা ঢুকাইয়া সজোরে একটা চাড় দিতেই প্রতিনিধানের ট্রাঙ্কের তলাটা ফাঁক হইয়া গেল। সে চুরি করিতেছে, হ্যাঁ, সে জানে। চুবিই করিতেছে সে। উদ্দেশ্যবিচারেই মহত্ত্ব প্রমাণিত হো, রীতিবিচারটা বর্বর প্রথা। ভগবান আছেন। যে চোর, যে নারীহর্তা তার জন্যও ভগবান আছেন। প্রতিনিধানের কাপড়ের তলায় কতগুলি নোট।
দরজায় কে টোকা দিল।
প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিল : “কে?”
—“আমি, বাবু। রিস্ এসেছে।”
—“এসেছে? বেশ জোয়ান রিক্স ত’ রে?” বলিয়া হাসিতে হাসিতে সে দরজা খুলিয়া দিল।
আর এক মুহুর্ত দেরি করিল না : “চল্লাম রে যদু।”
যদু কহিল,—“আর আসবেন না?”
–“না।” বলিয়া অন্ধকার সিড়ি দিয়া হোঁচট খাইতে খাইতে সে নামিতে লাগিল। উপর হইতে যদুর প্রশ্ন শোনা গেল : “দড়িতে টাঙানো আপনার ঐ সিল্কের জামাটাও আমার।”