মনে পড়ে সেই রাণীগঞ্জে শালবনের তলায় তাহাদের দুই জনকে ফেলিয়া সুধী যখন ইচ্ছা করিয়াই সরিয়া পড়িয়াছিল, তখন সেই ঘনায়িত তিমিরবন্যার উপরে সে যে-দুইটি স্থির আঁখিপদ্মকে দুলিয়া উঠিতে দেখিয়াছিল তাহা তাহার সমস্ত কৰ্ম্ম-জগতের পারে দুইটি ক্ষুদ্র বাতায়ন হইয়া বিরাট অ-দেখা আকাশকে উদঘাটিত করিয়া ধরিয়াছে। সে-দুইটি চোখই তাহাকে উদভ্রান্ত করিয়া ফিরিয়াছে। কিন্তু সেদুইটি চোখকে তুলিয়া আনিতে গিয়া নমিতাকে সে অন্ধ করিয়া আসিল বুঝি। কাড়িতে গেলেও পাওয়া যায় না এমন কোন্ রত্নের লোভে সে দিশাহারা হইল! অজয়ের হঠকারিতা তাহাকে এমন করিয়া পাইয়া বসিল কেন? কিন্তু ঐ জড়স্তুপে প্রাণ সঞ্চার করিতে হইলে আঘাত না করিয়াই বা কী উপায় ছিল!
সমস্ত দুপুরটা টো-টো করিয়া প্রদীপ সন্ধ্যাকালে এক রেষ্টুর্যান্টে ঢুকিয়া যা-তা কতগুলি গলাধঃকরণ করিল। এখন সে কোথায়। যাইবে? কতগুলি লোক লইয়া রাত্রিকালে সে নমিতাকে চুরি করিলেই ত’ পারিত। দলের লোকেরা নারী-হরণের এই নিদারুণ প্রয়োজনীয়তা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিত না নিশ্চয়। মূখ। মাটির ভারতবর্ষের চেয়ে ঐ মাটির দেহটির মূল্য অনেক বেশি। দেশ সম্বন্ধে প্রতির আধিক্য ভাবাকুলতার একটা দুর্বল নিদর্শন মাত্র, তাহা প্রত্যক্ষ ও প্রখর নয় বলিয়াই প্রদীপের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে হইল। তাহার চেয়ে নমিতার প্রতি তাহার এই প্রতি-নিশ্বাসের প্রেমে ঢের বেশি সত্য আছে। সব সত্যই সার্থক নয়। না-ই হোক। তবু এ সত্যকে সে আকাশের রৌদ্রের মত সমস্ত পৃথিবীতে বিকীর্ণ করিয়া দিয়া আসিয়াছে।
অগত্যা মেসেই সে ফিরিয়া আসিল। সমস্ত গা ব্যথা করিয়া জ্বর আসিয়া গেল—মাথাটা ছিঁড়িয়া পড়িতেছে। কিন্তু অজয়ের মত সে পলাইয়া বাচিবে না, এই ঘরে সে আত্মহত্যা করিবে। দেশ স্বাধীন না হোক, তাহাতে তাহার কিছু আসিয়া যাইবে না—তাহার চেয়েও বড় ব্যর্থতা তাহাকে গ্রাস করিয়াছে। একেবারে অপ্রয়োজনে এমন করিয়া সে প্রাণ দিবে—তাহাকে যে যতই ব্যঙ্গ করুক, তাহারা হৃদয়হীন, অমানুষ। সে রক্তের মাঝে অশ্রু দেখে, হত্যার অন্তরালে বৈধব্য। নিস্ফল কৰ্ম্মের পেছনে সে অতৃপ্তির হাহাকার শুনিতে পায়, প্রচেষ্টার পেছনে অভাবনীয় ব্যর্থতা। সে রাত জাগিয়া তারা দেখিয়াছে, ধূসর অতীতের কুয়াসায় বর্তমানকে ছায়াময় করিয়া তুলিয়াছে, নমিতার দুইটি শুষ্ণ-শীর্ণ ঠোঁটের প্রান্তে তাহারই একটি পিপাসা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছে। তাহার জীবন ত’ ভাগ্য-বিধাতা তাহার হিসাবের খাতায় বাজে-খরচের ঘরেই রাখিয়া দিয়াছেন—তাহার জন্য আবার জবাবদিহি কি? ঘরের মধ্যেকার পুঞ্জিত অন্ধকার যেন তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়াছে—এই তিমির-রাত্রির অবসান কোথায়? এই মেসের ময়লা বিছানায় শুইয়াই সে আকাশের জ্যোৎস্নায় গা ঢালিয়া দিয়াছে— সে-আকাশ সহসা এক নিশ্বাসে ফুরাইয়া গেল নাকি? কোথায় তাহার বাড়ি-ঘর, মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজন! কেহ নাই। কোথায় নমিতা!
প্রদীপ ঝট্ করিয়া উঠিয়া বসিল। না, আলো জ্বালাইতে হইবে না। কাহারো এখনো ফিরিবার সম্ভাবনা নাই। কাজটা এখনই সারিতে হইবে। এমন অকর্মণ্যকে নিজ হাতে মারিয়া ফেলার মত গৌরব কোথায়? প্রদীপ পকেটে বাঁ-হাতটা ডুবাইয়া দিল।
অমনিই দরজা ঠেলিয়া যদুর প্রবেশ। সে এমন বোকা, জ্বরের ঘোরে তাড়াতাড়িতে দরজাটায় পর্যন্ত খিল লাগায় নাই। যদু কহিল,
—“আপনার একখানা চিঠি এসেছে।”
—“চিঠি!” প্রদীপ আকাশ থেকে পড়িল,—তাহার ঠিকানা লোকে কি করিয়া জানিতে পারিবে? অজয়ের চিঠি নয় ত’? নতুন কোনো বিপদে পড়িল নাকি? কিন্তু বিপদে পড়িলেও তাহার ত’ চিঠি লিখিবার কথা নয়। তাহাদের মধ্যে এখন কোনো সম্বন্ধের সূত্র রাখাও ত’ আর সমীচীন হইবে না। প্রদীপ হাত বাড়াইয়া চিঠিটা নিয়া কহিল, “আলোটা জ্বালা ত’ শিগগির। কী আবার ফ্যাসাদে পড়লাম।”
লণ্ঠনটা জ্বালাইতেই প্রদীপ চিঠিটার ঠিকানা দেখিল,—এমন হস্তাক্ষর পৃথিবীতে আগে কোথাও দেখিয়াছে বলিয়া মনে পড়িল না। তাহার মা নয় ত’? তিনি কি আজো বাঁচিয়া আছেন?
মোড়কটা খুলিয়া ফেলিতেই নীচে নাম দেখিল : নমিতা।
প্রদীপ চীৎকার করিয়া উঠিল : “এই চিঠি তোকে কে দিল? ধাপ্পাবাজ! আমার অসুখের সময় আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে এসেছিস?”
যদু কহিল,—“না বাবু, ইয়ার্কি করতে যাব কেন? পিওন এসে দিয়ে গেছে। আপনি তখন বাড়ি ছিলেন না।”
—“পিওন দিয়ে গেছে? আমি বাড়ি ছিলাম না! তুই বলছিস কি, যদু?”
পোষ্টাফিসের ষ্ট্যাম্প, দেখিয়া বুঝিল, সত্যই,—চিঠিটা ডাকেই আসিয়াছে। দু’টার সময়কার প্রথম ছাপ, এখানে পৌঁছিয়াছে সন্ধ্যা সাতটায়। তবু যেন প্রদীপের বিশ্বাস হয় না : “পিওন দিয়ে গেছে? তুই ঠিক জানিস? কেউ চালাকি করেনি ত’?”
—“কে আবার খামের মধ্যে বসে’ চালাকি করতে যাবে?”
—“সত্যিই, কে আবার চালাকি করবে! চালাকি করে’ কার বা কী লাভ? কে বা জানে এ-সব? কিন্তু শচীপ্রসাদ যদি চালাকি করে? ও, তুই তাকে কি করে চিবি? সে আবার আমার চুলের ঝু টি টেনে ধরেছিল। আচ্ছা, আমিও দেখে নেব। তুই বডড সময়ে চিঠিটা দিয়ে গেছি, যদু। নইলে শচীপ্রসাদকে শাসন না করেই যে কি করে মরতে যাচ্ছিলাম! হ্যাঁ, তুই যা। বডড জ্বর এসে গেল রে যদু। এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দিয়ে যাস দিকি। আর, লণ্ঠনটা তক্তপোযের ওপর তুলে দে।”
লণ্ঠনটা তুলিয়া দিয়া যদু জল আনিতে গেল। কিন্তু এত কাছে আলো পাইয়াও চিঠিটা পড়িতে তাহার সাহস হইল না, চিঠিটা হাতে নিয়া মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। একবার চোখ বুলাইয়াই সে দেখিয়া নিয়াছে পত্রটি একটি কণা মাত্র, সামান্য কয়েক লাইন লিখিয়াই শেষ করিয়াছে। কিন্তু এমন নির্মম আঘাত করিয়া কিতাহার এমন প্রয়োজন ঘটিয়া গেল। অনুতাপ করিয়া ক্ষমা চাহিয়াছে বুঝি। কিম্বা হয় ত’ আরো ভৎসনা করিয়া পাঠাইয়াছে। তাহার জন্য আবার চিঠি কেন?