অবনীবাবু কহিলেন, “তোমার শাসন এখনো যথেষ্ট হয় নি! ভাল চাও ত’ এখনো বিদায় হও বলছি।”
—“যাচ্ছি, কিন্তু অভিনয়ের শেষ অঙ্ক এখনো বাকি আছে।”
—“না, নেই।” বলিয়া অবনীবাবু হঠাৎ তাহার ঘাড় ধরিয়া ফেলিলেন।
প্রদীপ সামান্য একটু হাসিল : “সামান্য ঘাড়-ধরা থেকে ছাড়া পাবার জন্য যুযুৎসুর সোজা পাঁচ আমার শেখা আছে। কিন্তু আপনি মাননীয় গুরুজন, আপনাকে ভূপতিত করে’ অপদস্থ করলে আমার মন খুসি হবে না।”
ভয়ে ভয়ে অবনীবাবু হাতের মুষ্টি শিথিল করিয়া দিলেন। শচীপ্রসাদ বলিয়া গেল : “আমি দিচ্ছি ফোন করে।”
প্রদীপ শান্তস্বরে কহিল,—“পুলিশ আসবার আগেই শেষ অঙ্ক শেষ করে ফেলি নমিতা। তুমি প্রস্তুত হও। তেমন কিছু ভয়ের কারণ নেই। আঘাতের পরিবর্তে স্নেহ দিতে হবে এ-শিক্ষা আমরা নতুন লাভ করেছি এ-যুগে। তোমাকে আমি ভালবাসি। কথাটার যদি কিছু অর্থ থাকে, তবে তার উচ্চারণেই আছে, অলস অনুভূতিতে তার প্রমাণ। নেই। এ-ভালবাসা তোমাকে জ্যোৎস্নালোকে শোনাবার মত নয়, স্পষ্ট দিনের আলোয় সমস্ত সমাজের মুখের ওপর প্রখর ভাষায় বলবার মত। তুমি ভারতবর্ষের প্রতিমা কি না জানি না, কিন্তু আমার আত্মার সহোদরা।”
উমা দেয়ালের দিকে পিঠ করিয়া একেবারে পাংশু হইয়া গিয়াছে। নমিতা তখনো ভয়ে উদ্বেগে থমথম করিতেছে—গায়ের বসন তাহার সুসন্নিবেশিত নাই, শ্বশুরকে দেখিয়াও সে মাথায় ঘোম্টা তুলিয়া দিল না,—সে হতচেতন, বিমূঢ়, স্পন্দহীন। প্রদীপকে তাহারই সম্মুখে অগ্রসর হইতে দেখিয়া সে ভয়ে এতটুকু হইয়া গেল। এমন অবশ্যম্ভাবী মুহূর্তে অবনীবাবু পৰ্য্যন্ত তাহাকে বাধা দিতে পারিলেন না।
যে-রক্ত আমার গৌরবের চিহ্ন হ’ল তাই তোমার কলঙ্ক হোক, নমিতা।” বলিয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য প্রদীপ দুই বাহুর মধ্যে হঠাৎ নমিতাকে বেষ্টন করিয়া ধরিল। ঠিক চুম্বন করিল কি না বোঝা গেল না, আলিঙ্গনচু হইয়া নমিতা সরিয়া গেলে দেখা গেল প্রদীপেরই কপালের রক্তে তাহার মুখ, বুক একেবারে ভরিয়া গিয়াছে। অস্বাভাবিক উত্তেজনার প্রাবল্য নমিতা আর সহিতে পারিল না, মুহমান অবস্থায় মেঝের উপর বসিয়া পড়িল।
প্ৰদীপ দুয়ারের দিকে হটিয়া আসিয়া কহিল,—“হয় ত’ এ-জীবনে আর দেখা হবে না, নমিতা। কিন্তু সংসারে লক্ষ-কোটি কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকবার অবকাশে এটুকু শুধু মনে করে’ সুখ পেয়ো যে তোমারই কলঙ্কের মূল্যে আরেক জন মহান্ ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে।” বলিয়া আর এক মুহূর্তও দেরি না করিয়া সে ডান-হাতে কপালটা চাপিয়া ধরিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
সিড়িতে যখন নামিয়াছে তখন উপর হইতে উমার কণ্ঠের ডাক শোনা গেল : “দীপ-দা, দাঁড়াও, মাথায় একটা ব্যাণ্ডেজ করে দি।”
প্রদীপ একবার উপরে চাহিল, কিন্তু একটিও কথা কহিল না।
১৭. প্রদীপ বড় রাস্তায় পড়িয়া
প্রদীপ বড় রাস্তায় পড়িয়াই ট্যাক্সি লইয়া কাছাকাছি একটা ডিসপেনসারিতে আসিয়া উঠিল। ডাক্তারটি পরিচিত। ট্যাক্সিভাড়াটা তিনিই দিয়া দিলেন যা হোক। পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন আঘাত গুরুতর হইয়াছে। যে পরিমাণে রক্তক্ষয় হইয়াছে তাহাতে অন্যান্য আনুষঙ্গিক পীড়া হইবার সম্ভাবনা। ব্যাণ্ডেজ করিয়া দিয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন,—“বাড়ি গিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকুন গে। সঙ্গে এই ওষুধটাও নিয়ে যাবেন।
ঔষধটা পকেটে পুরিয়া প্রদীপ পায়ে হাঁটিয়াই বাহির হইয়া পড়িল। চুপ করিয়া শুইয়া থাকিবার জন্যই সে মাথা পাতিয়া আঘাত নিয়াছে আর কি! কিন্তু ঘা-টার সুতীব্র যন্ত্রণা তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিতেছিল। অজয়ও এমন করিয়া নমিতারই জন্য আঘাত নিয়াছে, কিন্তু সেটা আকস্মিক একটা দুর্ঘটনা মাত্র, নমিতার নিজের হাতের পরিবেষণ নয়। অজয়ের আচরণের মধ্যে কোথায় যেন একটা চোরের নীচতা আছে, কিন্তু এমন একটা সুপ্রবল দস্যুতার প্রমত্ততা নাই। প্রতিযোগিতায় সে-ই বোধ হয় বেশি লাভ করিল।
কিন্তু কেন যে তাহার মধ্যে হঠাৎ এই দুর্দাম চঞ্চলতা আসিল সে ইহা বুঝিয়া পাইল না। নমিতা যে আর কাহারো অন্তরের অন্তঃপুরে কায়াহীন কল্পনার মতও বিরাজ করিবে তাহাতেও প্রদীপের ক্ষমা নাই। সে হয় ত’ নির্জনলালিত ভাবমূর্তিতেই নমিতাকে আস্বাদ করিত—তাহার সমস্ত কর্মমুখর ব্যস্ততায় নিশীথরাত্রির স্বপ্নরঞ্জিনীর মত; তাহার এই বিশ্বাসও ছিল যে, যাহাকে এমন করিয়া কামনা করা যায় সে বিজ্ঞানের স্বাভাবিক রীতিতেই প্রতিধ্বনি করিয়া উঠিবে। কিন্তু অজয়ের ব্যস্ত আচরণে সে-প্রতীক্ষার অবিচল তপস্যা যেন সহসা ভাঙিয়া শূন্যে বিলীন হইয়া গেল। সত্যকে ঘিরিয়া ভাবের যে কুজ্ঞটিকা ছিল তাহা মিলাইয়া যাইতেই প্রদীপের চোখে পড়ল নমিতাকে না হইলে তাহার চলিবে না। যেমন তাহার বুকের নিশ্বাস, পকেটের পাথেয়। হয় ত’ নমিতার পক্ষে কোনো লৌকিক উপমাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু তাহাকে লাভ করিতেই হইবে। প্রেমকে মহত্তর করিতে গিয়া যাহারা প্রণামের সাধনা করে, প্রদীপের তত প্রচুর ধৈৰ্য্য নাই। তাহাকে ছিনাইয়া, কাড়িয়া, মূলচ্যুত করিয়া তুলিয়া লইতে হইবে। পাওয়াটাই বড় কথা, রীতিটা অনর্থক। অজয় যতই কেননা নারীনিন্দুক হোক, ক্ষণকালের জন্য তাহার চোখে প্রদীপ নেশার ঘোর দেখিয়াছে—সে-নেশার পিছনে নিশ্চয়ই বঞ্চিত উপবাসী যৌবনের তৃষ্ণা ছিল। ছিল না? তাই ত’ সে যাইবার সময় নমিতার পাতিব্ৰত্যের প্রতি এমন নিদারুণ কশাঘাত করিতে দ্বিরুক্তি করিল না। নমিতা তাহার কাছে একটা প্রতীক মাত্র, কিন্তু প্রদীপের কাছে সে প্রতিমার অতিরিক্ত,—প্রাণবতী, দেহিনী। তাহাকে তাহার চাই—ভোগে, বিরহে, কর্মপ্রেরণায়, প্রদোষ-আলস্যে।