প্রদীপ কি করিয়া বসে তাহারই প্রতীক্ষায় উমা ঘামিয়া উঠিল। কানে-কানে বৌদিকে সংবাদটা দিবে কি না তাহাই সে বিবেচনা করিতেছিল। ভাবিয়াছিল এমন একটা সমাহিত ধ্যানলীন আননাভাসের প্রভাবে সে তাহার সমস্ত বিদ্রোহভাব দমন করিয়া তাহারই ঘরে আসিয়া উত্তীর্ণ হইবে। কিন্তু, বৃথা। প্রদীপ নমিতার মাথায় একটা ঠেলা মারিয়া দীপ্তকণ্ঠে কহিল,—“এসব কী করছ, নমিতা?”
নমিতা জ্বালাময় চক্ষু মেলিয়া যাহা দেখিল তাহাতে ভয়ে তাহার আকণ্ঠ শুকাইয়া গেল। কিন্তু আজ আর সে এই অনধিকার অত্যাচারের প্রশ্রয় দিতে পারিবে না। উদ্যত শাসনের ফণা তুলিয়া সে কহিল, “আমার পূজোর ঘরে না বলে কয়ে’ জুতে-পায়ে হঠাৎ ঢুকে পড়লেন যে। কে কী বলে তুমি এখানে নিয়ে এলে, ঠাকুর ঝি! জান না, এটা আমার পূজোর সময়?”
ফোটোটার সামনে নমিতা আবার একটা ঘট রাখিয়াছে, তাহার উপর আম্রপল্লবটি পৰ্য্যন্ত অম্লান। কোনো আয়োজনেরই ক্রটি ঘটে নাই। প্রদীপ জুতা দিয়া সেই ঘটকে লাথি মারিয়া উলটাইয়া ফেলিল : “কিসের তোমার পূজো? এই ভণ্ডামি তোমাকে শেখালে কে?”
উমা ভয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করিয়া উঠিল-জলে সমস্ত মেঝে ভাসিয়া গিয়াছে। নমিতা খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে প্রদীপের এই হিংস্র বীভৎস মুখের দিকে নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল। সে-চোখে সৌজন্যের স্বাভাবিক সঙ্কোচ নাই, উগ্রতেজ তাপসীর নির্দয় নির্লজ্জতা। সহসা সে সমস্ত শূন্য বিদীর্ণ করিয়া চেচাইয়া উঠিল : “কেন আপনি আমার ঘট ভাঙলেন? আপনার কী আস্পর্ধা যে ভদ্রমহিলার অন্তঃপুরে ঢুকে এই দস্যুতা করবেন? যাও ত’ ঠাকুর ঝি, বাবাকে শিগগির ডেকে নিয়ে এস।”
প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“সে-পার্টের মহল। নীচে একবার দিয়ে এসেছি। পুনরভিনয় হবে, হোক। যাও উমা, ডেকে আন। কিন্তু তোমার এই জঘন্য অধঃপতনের কারণ কি?”
উমা নিশ্বাস বন্ধ করিয়া এক পাশে ম্লান হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। না পারিল বাহির হইয়া যাইতে, না বা আসিল একটি অস্পষ্ট প্রতিবাদ।
—“অধঃপতন?” নমিতা আসন ফেলিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। সুদূর তিমিরাকাশে নীহারিকার দিগবর্তিকার মত; “সেকৈফিয়ৎ আমি আপনাকে দিতে যাব কেন? কে আপনি?”
—“আমি? অশুদ্ধ ভাষায় তোমারই কথার পুনরুক্তি করি—আমি ছাকাত।”
—“কিন্তু আমার উপর এই উৎপাত করবার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”
—“অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, নমিতা। তাও অধিকার করতে হয়।”
—“সে-অধিকার কেড়ে নেবার ক্ষমতা আপনার আজো হয় নি।” কণ্ঠস্বর আরো তীক্ষ করিয়া সে কহিল,—“আমি আমি-ই। তার থেকে একচুল আমি ভ্রষ্ট হ’ব না।”
প্রদীপ বিহ্বল হইয়া কহিল,—“তোমাকে ধন্যবাদ, নমিতা’। কিন্তু তুমি সত্যিই তুমি নও। তুমি সংস্কারশাসিতা, অন্ধ-প্রথার একটা প্রাণহীন স্তুপমাত্র। নইলে এই সব অপদার্থ উপচার নিয়ে দেবতার পূজো করতে বসেছ?” বলিয়া উল্টানো ঘটটাকে আবার একটা লাথি মারিয়া সে দূরে দেয়ালের গায়ে ছিটুকাইয়া মারিল।
নমিতা কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। অনুপায় মিনতিতে সে প্রার্থনা করিল,—“দয়া করে আপনি এ-ঘর থেকে চলে গেলে বাধিত হব। আমাকে অযথা পীড়ন করে লাভ নেই।”
—“আমি এ-ঘর থেকে চলে যাবার জন্যেই আসিনি পীড়ন করে’ লাভ নেই বটে, কিন্তু পীড়িত হওয়াতে লাভ আছে।”
নমিতা আবার চেঁচাইয়া উঠিল : “তুমি বাবাকে ডেকে নিয়ে এলে না, ঠাকুর-ঝি? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অপমান সইবো নাকি?”
উমা তবু নড়িল না। নমিতা সাময়িক বিমূঢ়তা বিসর্জন দিয়া বলিয়া উঠিল : “তবে আমিই যাচ্ছি নীচে।”
নমিতা যখন দুয়ারের কাছে আসিয়া পড়িয়াছে, প্রদীপ তৎক্ষণাৎ তাহার দুই বাহু বিস্তার করিয়া গাঢ়স্বরে কহিল,—“তুমি এই ব্যুহে প্রবেশ করবারই পথ জানতে, বেরবার কৌশল এখনো শেখনি। দাঁড়াও।”
বিদ্যুৎবিকাশের মত একটি ক্ষীণ মুহূর্তে দুইজনের স্পর্শ ঘটিয়াছিল। নমিতা আহত হইয়া সরিয়া গেল। প্রদীপের মনে হইল সে যেন হাতের মুঠোয় ক্ষণকালের জন্য মৃত্যুকে ছুঁইতে পাইয়াছে। তাহার অমৃতস্বাদে সে স্নান করিয়া উঠিল।
নমিতা একেবারে ছেলেমানুষের মত আর্তনাদ করিয়া উঠিল।
অবনীবাবুকে আর ডাকিয়া আনিতে হইল না। পেছনে শচীপ্রসাদও হাজির। দুয়ারের কাছে তাহাদের দেখা পাইতেই নমিতা কাঁদিয়া ফেলিল: “দেখুন এসে, ইনি আমার পূজার ঘরে ঢুকে কীসব উৎপাত শুরু করেছেন। আমার ঘট উলটে দিয়েছেন, আর মুখে যা আসে তাই বলে আমাকে অপমান করছেন। আমি যত না। বলছি।
-“নিশ্চয়, নমিতা। এ তোমার অপমান নয়, আশীৰ্বাণী! কিসের জন্য তোমার এই তুচ্ছ পূজা? এই মালা কার গলায় দিচ্ছ?” বলিয়া সুধী-র ফোটোর গলায় ঝুলানো মালাটা টানিয়া সে টুকরাটুকরা করিয়া দিল : “কিসের এই ধূপধূনো? দিনের বেলায় কেন আবার আলো জ্বেলেছ? আকাশে চেয়ে সূর্য দেখতে পাচ্ছ না?” বলিয়া প্রদীপ লাথি মারিয়া-মারিয়া পিসুজ ধূপতি সব উলটাইয়া দিতে লাগিল।
নমিতা রাগে অপমানে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। তাহার আর সহিল না; তাহার মুখ রক্তপ্রাচুর্যে একেবারে আগুন হইয়া উঠিয়াছে। সে তাড়াতাড়ি মেঝে হইতে ঘটটা কুড়াইয়া আনিয়া প্রদীপের মাথা লক্ষ্য করিয়া সজোরে ছুড়িয়া মারিল। হয় ত’ সতী বলিয়াই তাহার সে-লক্ষ্য ভ্রষ্ট হইল না। প্রদীপের ডান ভুরুর উপরে কপাল ফাটিয়া আনন্দাশ্রুর মত রক্ত ঝরিতে লাগিল।
প্রদীপ যেন এতক্ষণ ধরিয়া এই আঘাতটিকেই কামনা করিতেছিল। নমিতার পরিপূর্ণ পাণ্ডুর ওষ্ঠাধরেও এমন মাদকতা নাই। সে অন্তরের গভীর সুরে কহিল,—“তোমাকে নমস্কার, নমিতা। কিন্তু তোমার এই তেজ এই বিদ্রোহ সমস্ত পুরুষজাতির অত্যাচারের বিরুদ্ধে, আত্মঘাতী প্রথার বিরুদ্ধে, অভিমানী সমাজের বিরুদ্ধে। তোমার তেজের এই বলিষ্ঠ উলঙ্গ উজ্জ্বলতা সমস্ত পৃথিবীকে দগ্ধ করুক। আর পাহারাওয়ালা ডেকে কাজ নেই, শচীপ্রসাদবাবু।”