সত্য-সত্যই উমা প্রদীপের পাশে সোফায় বসিল। যেন ইহার মধ্যে এতটুকু দ্বিধা করিবার ছিল না। এই সান্নিধ্যের মধ্যে কোথাও জড়তা নাই, না বা স্লানিমা—যেন পরিচয়-প্রকাশের সামান্য একটি প্রচলিত রীতি মাত্র। কিন্তু অবনীবাবু অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। এইবার শাসনের অত্যাচারে উমাকেই নিজ্জিত হইতে হইল। প্রদীপ কয়েক মিনিটের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলুক।
অবনীবাবু কহিলেন,—“ওঠ এখান থেকে। এই বেহায়াটার পাশে বলি যে!”
শচীপ্রসাদ বলিল,-“ওর ছায়া মাড়ালেও অশুচি হতে হয়। ওঠ।”
উমা বিস্ময়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গেল। বলিল,-“কেন, কি হয়েছে? সেদিনো ত’ বাস্-এ পাশাপাশি বসে এলাম। অশুচি হ’ব? পরে গঙ্গাস্নান কব ‘খন, শচীপ্রসাদবাবু।”
—“ফের মুখে-মুখে তর্ক? ওঠ বলছি। অবাধ্য কোথাকার!” বলিয়া অবনীবাবু আগাইয়া আসিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিলেন।
মুহূর্তের মধ্যে কী যে হইয়া গেল কেহই স্পষ্ট অনুধাবন করিতে পারিল না।
—“আপনারা খানিকক্ষণ তর্ক করুন, আমি এই ফাঁকে নমিতার সঙ্গে কথাটা সেরে আসি।” বলিয়া পলক ফেলিতে না ফেলিতেই প্রদীপ ভিতরের খোলা অরক্ষিত দরজা দিয়া ছুটিয়া বাহির হইল। সামনেই সিড়ি। সিড়িগুলি লাফাইয়া লাফাইয়া পার হইতে হইতে সে কহিল, —“তাড়াতাড়ি পাহারওয়ালা ডেকে নিয়ে আসুন, শচীপ্রসাদবাবু। আমি নমিতাকে লুট করে নিয়ে যেতে এসেছি।”—কথাটা এইবারে একেবারে উপর হইতে আসিল : “লুণ্ঠনের সময়ে একটা সম্বৰ্ষ না বাধলে কোনোই মাধুৰ্য থাকে না।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য সকলেই একেবারে হিম, নিস্পন্দ হইয়া রহিল। সচেতন হইয়া শচীপ্রসাদ পশ্চাদ্ধাবন করিতে যাইতেছিল, অবনী বাবু বাধা দিলেন : “ঐ গুণ্ডাটার সঙ্গে তুমি একা পারবে না। তা ছাড়া বাড়ির মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি হওয়াটা ঠিক নয়।”
শচীপ্রসাদ কহিল,—“কিন্তু ঐ স্কাউঙুেলটাকে unseathed ছেড়ে দেবেন নাকি?”
অবনীবাবু একটু পাইচারি করিয়া কহিলেন,—“দেখি। ও ভীষণ বোম্বেটে, শচী। নিজের প্রাণের ‘পরেও ওর একবিন্দু মমতা নেই। ওর সঙ্গে পেরে উঠবে না। তুমি যখন ওর চুল টেনে ধরেছিলে তখন ভয়ে জিভ আমার পেটের মধ্যে সেধিয়ে গেছল।”
উমা কহিল,—“আপনার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে দীপদা-র চুলের বিনিময়ে মুণ্ডুটা আপনাকে দিতে হয় নি।”
শচীপ্রসাদ বিরক্ত হইয়া কহিল,—“তবে ঘরে-বাইরে আপনি মুখ বুজে এ-সব ডাকাত বোম্বেটের অত্যাচার সইবেন নাকি? কিছুই এর বিহিত করবেন না? আইন-আদালত নেই?”
——“আছে। তবে যে লোক সব অত্যাচার হাসিমুখে সইতে প্রস্তুত, তার সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ নয়। যত নষ্টের গোড়া ঐ বে-টা। তুই যা ত’ উমা, বৌমার সঙ্গে ঐ হতচ্ছাড়াটার কি-না-কি দরকারী কথা আছে। ওকে পাশের বাড়ি নিয়ে যা ত’, লক্ষ্মী। বুঝলি, আবার যেন কিছু মনে না করে। পরে আমি থানায় গিয়ে একটা ট্রেসপাসের রিপোর্ট লিখিয়ে আসব।”
উমা এইবার কিছু বুঝিতে পারিয়াছে। তাড়াতাড়ি উপরে আসিয়া দেখিল, প্রদীপ বারান্দায় দাঁড়াইয়া একটা ঘরের বন্ধ দরজার ফাঁকে উঁকি দিতেছে। উমা হাসিয়া কহিল,—“এটা নিরিমিষ্যি রান্নার ঘর। দুপুর বারোটার আগে এর উনুনে আগুন দেওয়া হয় না। দেখছেন না বাইরে থেকে তালা-বন্ধ আছে?”
প্রদীপ দেখিল। কহিল,—“নমিতা তা হলে কোন্ ঘরে?” * দক্ষিণের দিকে আঙুল দেখাইয়া উমা বলিল,-“ঐ যে। আসুন আমার সঙ্গে। বৌদি এখন পূজোয় বসেছেন। পূজোয় বসলে কারু সঙ্গে আবার কথা কন না। টু-টি পর্যন্ত না। প্রায় দু’ ঘণ্টা।”
প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“দু’ ঘণ্টা! বল কি? আমি কি দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তার এই নির্লজ্জ মৌনব্রতের তারিফ করব নাকি? আমার দু’ সেকেণ্ডও সইবে না। চল।”
উমা অবাক হইয়া প্রদীপের মুখের দিকে চাহিল। তাহার মুখের সেই সৌম্য উদারসিগ্ধতা কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে, চক্ষু দুইটা অনিদ্রায় তপ্ত, শাণিত—সমস্ত দেহ ঘিরিয়া এমন একটা রুদ্র রুক্ষতা যে, উমার মনটা দুরুদুরু করিয়া উঠিল। প্রদীপ কহিল,—“নীচে একবার যাবে, উমা? দেখ ত’, ওরা সত্যি সত্যিই পাহারওয়ালা ডেকে আল কিনা।”
উমা বোধ হয় এই ইঙ্গিতটুকু বুঝিল। তাহার কথার সুরে সুগোপন একটি অভিমান : “যাচ্ছি। কিন্তু বৌদি যে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছেন। তার ধ্যান ভাঙানো চলবে না, দীপ-দা। একদিন সামান্য একখানা চিঠি দরজার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম বলে আমার অপ্রস্তুতের আর শেষ রইলো না। বেদি সারাদিন খেলেন না, চান করলেন না—সমস্তক্ষণ কেঁদে-কেঁদে ঘর-দোর ভাসিয়ে দিতে লাগলেন। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। তার ওপর এখন আর উপদ্রব না-ই করলাম আমরা। চলুন আমার ঘরে, আমাকে রাসে পড়াবেন। খানিক বাদে আমি এসে খোঁজ নিয়ে যাব।”
নমিতার ঘরের সম্মুখে তখন তাহারা আসিয়া পড়িয়াছে। দরজাটা ভেতর থেকে তেজানো—নিঃশব্দ, নিশ্বাসহীন। প্রদীপ কহিল, “উপদ্ৰবই চাই, উমা। ভালবেসে নয়, উপদ্রব করেই জড় অচল প্রস্তরকে দ্রব করা চাই। তোমার সেদিনকার উপদ্রবে সে উপোস করেছে, আজকে না-হয় আত্মহত্যা করবে। তবু সে কিছু একটা করুক।”
বলিয়া উমার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই প্রদীপ হাত দিয়া ঠেলা মারিয়া দরজা খুলিয়া দিল। ধ্যানাসীনা তন্ময়ী নমিতা একবার চমকিয়া উঠিল, কিন্তু চোখ মেলিল না—সুকুমার মুখের উপর কোথা হইতে একটা অসহিষ্ণু অথচ অটল দৃঢ়তার তেজ ফুটিয়া উঠিল! দরজা খুলিয়া ফেলিয়া প্রদীপ এ কী দেখিতেছে! কয়েক মুহূর্তের জন্য সে পাথর হইয়া রহিল। নমিতা সদ্য-স্নান করিয়া পূজায় বসিয়াছে, সামনের দেয়ালে তাহার স্বামীর ফোটোটা হেলানো—চন্দনলিপ্ত, মাল্যবিভূষিত। বাঁ-পাশে পিতলের পিলসুজে একটা প্রদীপ, ধূপতিতে ধূনা জ্বলিতেছে—সমস্ত ঘরটি আচ্ছন্ন করিয়া একটি সুগভীর বৈরাগ্যের শীতল পবিত্রতা। নমিতার মাথায় ঘোমটা নাই, ভিজা চুলগুলি পিঠের উপর দিয়া নামিয়া আসিয়া মেঝেটা স্পর্শ করিয়াছে—গায়ে বাহুল্যবস্ত্র নাই, একখানি নরম গরদের থান্ শাড়ি অযত্নে ন্যস্ত হইয়াছে। সর্বাঙ্গে পদ্মাভা, অমৃতগন্ধ! বসিবার সহিষ্ণু ভঙ্গিটিতে কি কঠোর সুষমা, অগ্নিশিখার মত শীর্ণ ও ঋজু শরীরে ব্রাহ্মমুহূর্তের আকাশ-শ্রী! প্রদীপ যেন তাহার চর্মচক্ষুতে পুৰাণবর্ণিতা তপস্বিনী শকুন্তলাকে দেখিতেছে—আদিম কবিতায় যে বিরহিণীর মুর্তিকল্পনা হইয়াছিল, সেই শরীরী কল্পনা! তপস্যা-পরীক্ষিত প্রেম! এই মূর্তিকে সে স্পর্শ করিবে।