অবনী বাবু বাহিবের দরজার দিকে আঙুল দেখাইয়া কহিলেন, “তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে কি না বল।”
মাথার চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে পরম উদাসীনের মত প্রদীপ বলিল,-“যেতে বলেই সহজে চলে যাওয়া যায় না। ওপরে যাবার যেমন বাধা আছে, তেমনি বাইরেও।”
অবনী বাবু আরো রুখিয়া উঠিলেন : “না। তুমি যাও বেরিয়ে। এক্ষুনি।”
তেমনি নির্বিকার শান্তস্বরে প্রদীপ বলিল,-“এক কথা কত বার করে’ বলব! আরো স্পষ্ট উত্তর চা নাকি? আমি যাব না, অর্থাৎ নমিতার সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে। যদি বাধা পাই, সে-বাধা স্বীকার করে’ পরাস্ত হয়ে ফিরে গেলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না। বেশ ত’, তাকেই এখানে ডাকুন। কিম্বা যদি চান, তাকেও রাস্তায় বার করে দিতে পারেন। আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই।”
অবনী বাবু গর্জিয়া উঠিলেন : “জান, তোমাকে এক্ষুনি পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি?”
—“জানি বৈকি। কিন্তু দয়া করে’ ওটি কবেন না। সামান্য নারী-হরণের অভিযোগে পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণের ইচ্ছে নেই। কিন্তু বৃথা বাকবিতণ্ডা করে লাভ কি? যদি বলেন, আমি-ই না-হয় এখানে নমিতাকে ডাকি।” বলিয়া প্রদীপ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়া গলা চড়াইল : “নমিতা! নমিতা!”
অবনী বাবু কহিলেন,—“তুমি যাও ত’, শচীপ্রসাদ। শিগগির। মোড়ের থেকে একটা পাহারাওয়ালা ডেকে নিয়ে এস ত’।”
শচীপ্রসাদ বুক ফুলাইয়া সেনাপতির ভঙ্গীতে তর্জনী হেলাইয়া কহিল,—“যা শিগগির এখান থেকে। নইলে আপনার মত দু’-দশটাকে আমি ঘুষি মেরে সমান করে দিতে পারি।”
একটা হাই তুলিয়া প্রদীপ কহিল,—“আর সমান করে কাজ নেই, ভাই। মোড়ের থেকে পাহারওয়ালা ধরে নিয়ে এস গে। ( অবনী বাবুর প্রতি) আপনাদের বাড়িতে ত’ ফোন আছে। থানায় একটা খবর পাঠিয়ে দিন্ না। লরি-বোঝাই সেপাই এসে যাবে’খন। আমার পালাবার আর পথ থাকবে না। ততক্ষণে নমিতার সঙ্গে দরকারী কথাটা ধীরে-সুস্থে সেরে নেওয়া যাবে।” আড়মোড়া ভাঙিয়া জড়াইয়া জড়াইয়া কহিল, “কাল সারা রাত্রি আর ঘুম হয় নি। নমিতার অধঃপতনে সমস্ত আকাশ মাটিতে মূর্মিত হয়ে পড়েছে।”
অবনী বাবু ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন : “কি, কি? নমিতার কি হয়েছে বল্লে?”
—“পাহারওয়ালা আগে ডাকুন। বলছি।”
শচীপ্রসাদ দিব্যি একটি ঘুসি পাকাইয়া প্রদীপের মুখের কাছে আগাইয়া আসিল। কহিল,—“আবার কথা কইবে ত’ বত্রিশটা দাঁত। গুঁড়ো করে ফেলব।”
প্রদীপ ইচ্ছা করিলে অনেক কিছুই করিতে পারিত হয় ত’। কিন্তু শচীপ্রসাদের উদ্ধত ঘুসিকে স্বচ্ছন্দে এড়াইয়া আবার সোফাটায় আসিয়া নিলিপ্তের মত বসিয়া পড়িল। বলিল,-“বেশ, আপনাদের সঙ্গে কথা আমি না-ই বা কইলাম। অধিক বীরত্ব প্রকাশ করূলে আমি যে গান্ধি হয়ে বসে থাকূব এটা আশা করবেন না। তার চেয়ে থানায় একটা খবর দি। দাঁত গুড়ো করে লাভ নেই, বাজারে কিনতে পাব, বুঝলেন?”
অবনী বাবু সেই হইতে দরজা আগলাইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি কহিলেন,—“তুমি ত’ ভদ্রলোক, কিন্তু অপমানববধ বলে কিছুই তোমার নেই নাকি?”
—“আমরা আজো ততটা মহৎ হ’তে শিখিনি। অপমানিত হয়ে পিঠ দেখানোটাই অপমান, অপমানকে শাসন করাটাই আমাদের ধর্ম।”
অবনী বাবু কহিলেন,—“আচ্ছা, দাঁড়াও। তা হলে শচীপ্রসাদ, ডাক ত’ চাকর দু’টোকে।”
প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“কেন, পাহারওয়ালা কি হ’ল? দেরি হয়ে যাবে বুঝি? বাঃ, আমি ত’ আর পালাচ্ছিলাম না। আচ্ছা, ডাকুন। ক’টা চাকর? দুটো? এই ছোট সংসারে দু’টো চাকর লাগে?”
—“কিসের চাকর?” বলিয়া শচীপ্রসাদ বাঁ-হাতের মুঠিতে প্রদীপের চুলগুলি চাপিয়া ধরিয়া কহিল,—“তুমি উঠবে কি না বল; নইলে–”
আবার সে ঘুসি তুলিল।
এমন সময় ভেতরের দরজা দিয়া দ্রুতপদে উমা আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। প্রদীপের কণ্ঠে নমিতার ডাক তাহার কানে গিয়াছিল বুঝি। কিন্তু ঘরে আসিয়া এমন একটা অভাবনীয় দৃশ্য দেখিয়া সে নিমেষে কাঠ হইয়া গেল। শচীপ্রসাদ প্রদীপের চুলের ঝুটি ধরিয়া ঘুসি মারিতে উদ্যত, বাবা রাগে গম্ভীর, স্তম্ভিত হইয়া রহিয়াছেন—আর সোফায় বসিয়া উদাসীন প্রদীপ অলস-স্বরে বলিতেছে : “দাঁত ভাঙলে আবার দাঁত পাব, কিন্তু আপনার চশমার ওপর যদি একটা ঘুসি মারি, তবে সমস্ত পৃথিবীর বিনিময়েও চোখ আর ফিরে পাবেন না। হ্যাঁ, দাঁতের চেয়ে চোখটাই বেশি প্রয়োজনীয়। বেশ, ভালো হয়ে বসছি। মারুন্।” বলিয়া সে দুই পাটি শক্ত পরিষ্কার দাঁত বাহির করিয়া ধরিল।
ব্যাপারটা উমা কিছুই বুঝিতে পারিল না। কি এমন হইতে পারে যে শচীপ্রসাদ পৰ্যন্ত প্রদীপের মুখের উপর ঘুসি বাগাইয়াছে, আর অবনী বাবু তাহারই প্রয়োগনৈপুণ্য নিরীক্ষণ করিবার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছেন। একটি দোদুল্যমান মুহুৰ্ত্তমাত্র। উমা তাড়াতাড়ি প্রদীপের সামনে আসিয়া পড়িল। বলিল,-“এ কী!”
প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“শচীপ্রসাদকে বিয়ে করো না, উমা। দেখেছ, চুলের ঝুটি কেমন শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে! শিগগির ওর পেটে সুড়সুড়ি দাও। নইলে চুল ও কিছুতেই ছাড়বে না।”
উমা শচীপ্রসাদের হাত ছাড়াইয়া নিয়া কহিল,—“আপনার এ কী দুঃসাহস! দীপ-দা’র গায়ে হাত তোলেন।”
অবনীবাবু স্থান পরিবর্তন করিয়া কহিলেন,—“তুই সব তাতে সর্দারি করতে আসিস কেন? যা তেতরে। ঐ গোয়ার ইতরটাকে সায়েস্তা আমরা করবই।
বার-কতক ইতস্তত চাহিয়া উমা কহিল,—“কেন, কি হয়েছে?”
-“সে অনেক কথা।” প্রদীপ সোফাটার উপর একটু সরিয়া বসিয়া কহিল : “বোস আমার পাশে। এবার শচীপ্রসাদ পাহারওয়ালা ডাকৃতে যাবেন। পাহারওয়ালা আসুক। সব শুনতে পাবে।”