এতদিনে নির্বাক দেবতা বুঝি কথা কহিলেন। কাল রাতে সুধীকে নমিতা স্বপ্ন দেখিয়াছে—কি নিশ্রী স্বপ্ন! স্বামী তাহাকে বলিতেছেন। “এ-সব তুমি কি ছেলেখেলা করছ, নমিতা? আমাকে তুমি এমন করে বেঁধে না।”
যে দিন নমিতা কাকার বাড়ি ছাড়িয়া প্রথম এখানে আসে সেদিনও সুধী স্বপ্নে তাহাকে এই কথা বলিয়াছিল। কিন্তু কাল রাতের স্বর যেন অনেক স্পষ্ট, দৃঢ়। নমিতা বলিল : “তবে আমি কি নিয়ে থাকব?”
উত্তর হইয়াছিল : “যে তোমাকে ভালবাসে তাকে নিয়ে।”
—“তুমি আমাকে ভালবাস না?”
—“না।”
কে তবে তাহাকে ভালবাসে এমন একটা প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয় জ্ঞানেই নমিতা আর উত্থাপন করে নাই। সে বুঝি মনে-মনে তাহার নাম জানিত। তবু গায়ে পড়িয়া সুধী কহিল,—“তোমার প্রদীপকে মনে পড়ে? সে।”
লজ্জায় অরুণবর্ণা উষার মত নমিতা কাঁপিয়া উঠিল। তখন পূৰ্বদিকে প্রভাত হইতেছে। জাগিয়া উঠিয়া নমিতার ইচ্ছা হইল স্বামীর ফটোটা ছুড়িয়া ভাঙিয়া ফেলে।
১৬. পথ আগলাইয়া দাঁড়াইবে
একেবারে নীচেই যে কেহ পথ আগলাইয়া দাঁড়াইবে প্রদীপ তাহা ভাবে নাই। তাই বসিবার ঘরে অবনী বাবুকে খবরের কাগজে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল। পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার সম্ভাবনা ছিল না। কেননা পাশেই একটা চেয়ারে বসিয়া শচীপ্রসাদ ধীরে-ধীরে টেবিল বাজাইতেছে।
নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনীটা চাপিয়া ধরিয়া সঙ্কেত করিলে শচীপ্রসাদ নিশ্চয়ই ক্ষান্ত হইবে না; বরং দুর্বিনীত ব্যবহার সন্দেহ করিয়া হয় ত’ এমন ভাবে সম্বর্ধনা করিবে যে অবনী বাবু তাহার তন্ময়তা ভুলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রদীপের জামার গলাটা চাপিয়া ধরিবেন। কিন্তু উপরে গিয়া নমিতার সঙ্গে তাহার দেখা না করিলেই নয়—দেখা তাহাকে করিতেই হইবে। চুরি করিয়া আসিতে তাহার লজ্জা ছিল না, কিন্তু গভীর রাত্রিতে আসিলে দরজা সে খোলা পাইত না নিশ্চয়ই–পাঁচিল ডিঙাইয়া সে তাহার সাহসকে দুর্ধর্ষ করিতে গিয়া হাস্যাস্পদ করিতে চায় না। বেশ ত, অবনী বাবু জানুন, ক্ষতি নাই! নমিতার মুখোমুখি দাঁড়াইয়া সে বোঝা-পড়া করিবেই। কোন বাধাই আজ আর যথেষ্ট নয়।
শচীপ্রসাদই আগে কথা কহিল,—“কি মনে করে?”
অবনী বাবু খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিলেন। সামনেই প্রদীপকে দেখিয়া এক নিমেষে তাঁহার মুখ গম্ভীর ও কুটিল হইয়া উঠিল। চোখ দুইটা বাকাইয়া তিনি তাহার আপাদমস্তক দেখিয়া লইলেন—সমস্ত অবয়বে স্বাভাবিক ভদ্রতার লেশমাত্র লালিত্যও তাহার চোখে পড়িল। শীর্ণ কঠোর দেহটায় যেন একটা নিষ্ঠুর রুক্ষতা গাঢ় হইয়া আছে—কোথাও এতটুকু বিনয়নম্র কোমলতা নাই। চোখ দুইটা রাঙা, কপালের রেখায় কুটিল একটা ষড়যন্ত্র, সমস্ত মুখের ভাবে গূঢ় একটা ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা! চেহারাটা অবনী বাবুর একটুও ভাল লাগিল না। অমন একটা দৃঢ় স্থিরসঙ্কল্প মূর্তি দেখিয়া তিনি প্রথমে একটু ঘাবড়াইয়া গেলেন। কহিলেন,—“অনেক দিন পরে যে! এখানে?”
শেষের প্রশ্নটার হয় ত’ এই-ই অর্থ ছিল যে, সেদিন অমন অপমানিত হইবার পর আবার কোন প্রয়োজনে মুখ দেখাইতেছে? প্রদীপ ঠোঁট দুইটা চাপিয়া ধরিয়া একটু হাসিল, সে-হাসি তলোয়ারের চেয়েও ধারালো। সে-সঙ্কেতকে স্পষ্ট করিবার জন্য কথা বলিতে হয় না।
প্রদীপ একটিও কথা না বলিয়া বাড়ির ভিতরের দরজার দিকে অগ্রসর হইল। অবনী বাবু বিরক্ত হইয়া কহিলেন,—“ও-দিকে কোথায় যাচ্ছ?”
প্রদীপ স্পষ্ট সংযত স্বরে কহিল,—“নমিতার সঙ্গে আমার দরকার আছে।”
ইলেকট্রিক শক পাইয়া অবনী বাবু চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিলেন: “নমিতার সঙ্গে দরকার? তার মানে?”
প্রদীপ কহিল,—“মানে বলতে গিয়ে আমি অকারণে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার কাজ আছে। ভীষণ দরকার! আমাকে যেতেই হবে ওপরে।”
অবনী বাবু তাড়াতাড়ি আগাইয়া প্রদীপের পথরোধ করিলেন; শচীপ্রসাদও তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। অবনী বাবু তাঁহার দুই বলিষ্ঠ হাতে প্রদীপের কাঁধ দুইটায় ঝাকানি দিয়া বলিলেন,—“জান, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি? তোমার এ-বেয়াদবিকে আমরা সহ্য করবো না, জান?”
এই সামান্য দৈহিক অত্যাচারে প্রদীপ ধৈৰ্য্য হারাইল না। এত অনায়াসে তাহার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিতে দিতে নাই। সে বিদ্রোহী বটে, কিন্তু কৌশলীও। তাই সে স্বচ্ছ অথচ উজ্জ্বল হাসিতে মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া কহিল,—“সব জানি। কিন্তু তবু আমার দেখা না করলেই নয়।”
শচীপ্রসাদ বৰ্বরের মত খেকাইয়া উঠিল : “এ তোমার কোন্ দেশী ভদ্রতা?”
প্রদীপের মুখে সেই হাসি : “আমরা যে-দেশ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি, সেই দেশের। আপনি তা বুঝবেন না।”
পরে কাঁধের উপর অবনী বাবুর আঙুলগুলিতে একটু চাপ দিয়া সে কহিল,—“ছাড়ুন, আমার সত্যিই দেরি করবার সময় নেই।”
অবনী বাবু বজ্রের মত হাঁকিয়া উঠিলেন : “না।”
বলিয়া বাঘের থাবার মত দুই হাতে জোর করিয়া তাহাকে সামনের সোফাটার উপর বসাইয়া দিলেন। প্রদীপ নেহাৎই মাধ্যাকর্ষণের শক্তিতে বিনা প্রতিরোধে সোফার উপরে ধুপ করিয়া বসিয়া পড়িল।
অবনী বাবু তীক্ষ্ণস্বরে কহিলেন,—“নমিতার সঙ্গে তোমার কী দরকার?”
প্রদীপ কহিল,-“সে-কথা আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে আসিনি। সেটা গোপনীয়।”
—“গোপনীয়! তোমার এতদূর আস্পর্ধা? একজন অন্তঃপুরিকা হিন্দু-কুল-বধূর সঙ্গে তোমার কী দরকার হতে পারে?”
প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“অন্তঃপুরিকা হিন্দু-কুল-বধূ বলেই বেশি দরকার। সে ত’ আর বাইরে বেরয় না যে, তাকে গড়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে পরামর্শ করুব। সে নেহাৎই বন্দিনী, তাই দরকারী কথা সেরে নেবার জন্যে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। এখানে ছাড়া আর ত’ তার দেখা পাওয়া যাবে না।”