এত লোক-জন, তবু এ-বাড়িতে তাহার বড় একলা লাগে। মা কাছে থাকিলে তাহার এমন খারাপ লাগিত না। সে-দিন মা তাহাকে মরিবার জন্য এক বোতল কেরোসিন তেল সামনে ধরিয়াছিলেন; তবু সে মরিলে মা-ই বেশি কাঁদিবেন বলিয়া সে স্বচ্ছন্দে বোতলটা স্বস্থানে। রাখিয়া আসিয়াছিল। মাকে কাছে পাইলে তাহার বুকে মুখ গুঁজিয়া সে এই বলিয়াই কাদিত : মা গো, এত পূজা করিয়াও তৃপ্তি পাওয়া। যায় না। এমন একটা অকর্মণ্য আলস্যের মধ্যে ভগবানকে পাইয়াই বা আমি করিব কি? রাত্রে তাহার একা শুইতে বড় ভয় করে, খালি মনে হয়, কে যেন তাহাকে বাহিরে টানিয়া নিবার জন্য তাহার দৃঢ় ব্যর্থ হাত প্রসারিত করিয়া দিয়াছে। অরুণা প্রথম-প্রথম তাঁহার কাছে শুইবার জন্য অনুরোধ করিতেন বটে, কিন্তু পূজা-ঘর ছাড়িয়া সে দিনে-রাত্রে কোথাও বাহির হইবে না বলিয়া পণ করিয়াছে তাহাকে। টলায় কাহার সাধ্য। মেঝের উপর বিছানা করিয়া শুইয়া তাহার সহজে ঘুম আসে না; খোলা জানালা দিয়া বহুদূরের তারাগুলি চোখে পড়ে। ঐ একটি তারার মধ্যেই হয় ত’ তাহার স্বামীর সস্নেহ সঙ্কেত আছে—এমনি ভাবে সে এই প্রাকৃতিক আকর্ষণের একটা উদার ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু খানিকক্ষণ চাহিতেই তারাগুলি একত্র হইয়া একজনের মুখের মত প্রতিভাত হয়। সেই মুখের প্রত্যেকটি অবয়ব স্পষ্ট হইতে থাকে। নমিতা এমন বিভোর হইয়া পড়ে যে, সমস্ত আকাশ ব্যাপিয়া তাহার স্বামীর ইঙ্গিতের একটি কণাও আর কোথাও অবশিষ্ট থাকে না। কখন আবার জ্ঞান হয়; পরপুরুষের দৃষ্টি হইতে নিজেকে সম্বরণ করিতেছে এমনি ভাবে জানালাটা বন্ধ করিয়া দেয়; আলো জ্বালাইয়া গীতা পড়িতে বসে। এইবার শুইবার সময় স্বামীর ফটোটা সে পাশে লইয়া শোয়।
উমা ঠাট্টা করিয়া বলে : “তোমার স্বামী-পূজার এত ঘটা দেখে সন্দেহ হয়, বৌদি।”
নমিতা প্রশ্ন করে : “কিসের সন্দেহ?”
—“মনে হয় যে-কামনাকে তুমি জয় করছ বলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছ। সেটাতেই সপ্রমাণ হচ্ছে যে, কামনা তোমার অণুতে-অণুতে।”
নমিতা আঁৎকাইয়া উঠিল : “তার মানে?”
—“তার মানে স্বামী হারিয়েও তুমি স্বামী চাও। সে-যুগের সাবিত্রী এর চেয়েও কঠিন তপস্যা করেছিল কি না জানি না, কিন্তু যম সত্যবানকে ফিরিয়ে দিয়ে সাবিত্রীর মুখ রেখেছিল; নইলে স্বামী-বিহনে তার সেই কাঙালপনার লজ্জা সে সইতো কি করে? তোমার এই বাড়াবাড়ি দেখে মনে হয় পুরুষের সঙ্গ-কামনার উর্দ্ধে তুমি আজো ওঠনি।”
নমিতা প্রতিবাদ করিল : “পুরুষ কি বলছ, উমা? আমার স্বামী–দেবতা, ঈশ্বরের প্রতিভূ।”
উমা ঘাড় হেলাইয়া কহিল : “হোক। যে-দেবতার মূর্তি ভাঙে, সেই ভাঙা টুকরো পূজো না করে আরেকটা গোটা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেই তার পূজোর অর্থ হয়। সে-মূর্তি তোমার দেশাত্মবোধে হোক, প্রেমে হোক্, রোগীসেবায় হো—প্রতিষ্ঠিত কর। মৃত স্বামী-আরাধনায় নয়। এটা একটা তুচ্ছ আচরণ।”
নমিতা রাগিবার ভাণ করিল : “অমন ঈশ্বরনিন্দা করো না, উমা। স্বামী-পূজা আমার একটা আচরণ মাত্র নয়, আমার ধর্ম। বিরহবোধ মনের একটা পবিত্র প্রসাধন।”
—“ভালো করে ভেবে দেখ সে-বিরহবোধ কি মনের একটা দুৰ্বলতা নয়?”
—“আমি ভালো করে ভেবে দেখেছি।”
—“আমি হলে কিন্তু ফোটো পাশে না শুইয়ে একটা আস্ত জ্যান্ত লোক পাশে শোয়াতাম। সতীত্বের এমন অপমান করতাম না।”
নমিতা স্নিগ্ধ-কণ্ঠে উত্তর দিয়াছিল : “আমি হয় ত’ এতদিন তাই করে আসছিলাম।”
দুপুর বেলাটাই তাহার কাছে দুৰ্ব্বহ হইয়া উঠে। তখন রাস্তায় একটা ফিরিওলার ডাক, একটা মোটরের শব্দ কিম্বা পথচারীদের ছোট ছোট কোলাহল শুনিবার আশায় সে কান পাতিয়া থাকে। কোনো কাজেই মন বসে না, কি কাজই বা সে করিবে? তখন অবাধ্য চিত্ত লঘু একটি প্রজাপতির মত নবীন কুণ্ডুর লেইনের বাড়িতে ঘুরিতে থাকে। নীচের তলা ছাড়িয়া উপরে আর উঠিতে চাহে না। সেই অযত্নবিন্যস্ত অপরিষ্কার ছোট ঘরখানিকে সে পরম মমতায় স্পর্শ করে—সেই ছেড়া বিছানা, নোংরা মেঝেটা, দেয়াল হইতে চুণ-বালি খসিয়া পড়িয়াছেকাহারো ভ্রূক্ষেপ নাই। জানালার ও-পিঠে শার্টটা মেলিয়া দিয়াছে, কেহ যদি হাত বাড়াইয়া টানিয়া নেয় তাহাতে ত’ ভারি আসিয়া যাইবে! ছেড়া হাঁ-করা জুতা-জোড়া পর্যন্ত সেলাই করিয়া লইবার নাম। নাই। এমনি দুপুর বেলায় আসিয়া ভাত চাহিত। ঘরে যেন তাহার কে আছে, সযত্নে ভাত বাড়িয়া বসিয়া থাকিবে। পাছে স্নান করিতে আসিয়া জল না পায় এই জন্য নমিতা কত দিন চাকরটাকে চৌবাচ্চার জল ছাড়িয়া দিতে চুপি-চুপি বারণ করিয়াছে। তবু যদি তাহার হুস থাকিত!
এমনি এক দুপুর বেলায় অস্থির হইয়া নমিতা অবনী বাবুকে আর না বলিয়া পারিল না : “বাবা, আমাকে কোনো একটা ইস্কুলে ভর্তি করে দিন, আমার দিন আর কাটে না।”
অবনী বাবু মায়া করিয়া কহিলেন,—“ধর্মের মধ্যে এই ত’ ভালো পথ পেয়েছ মা, এর চেয়েও ভালো স্কুল কি কিছু আছে?”
নমিতা মাথা হেঁট করিয়া রহিল; অনেক কথা বলিবার ছিল, কিছুই বলিতে পারিল না। আঁচল খুটিতে খুঁটিতে অনেক পরে কহিল, “অন্তঃপুরে লেখা পড়া : শেখবার কোনো বন্দোবস্ত করা যায় না? যেমন সংস্কৃত, ইংরিজি।”
অরুণা বাধা দিলেন : “না, ও-সবে কাজ নেই। দিন না কাটে ঘরের কাজ-কৰ্ম্মও ত’ করতে পার। রাত-দিন ধৰ্ম্ম আবার চোখে ভাল দেখায় না।”
কতটুকু ধর্মাচরণ যে ভালো দেখায় তাহারই হিসাব করিতে করিতে নমিতা তাহার ঘরে ফিরিয়া আসিল। ঘরের কাজ-কর্ম সে আর কত করিবে? করিবার আছেই বা কি? তবু তাহার অবসরযাপনের ক্লান্তির আর সীমা নাই। এখন দুপুরেও সে স্বামী-পূজা শুরু করিয়াছে।