কে যেন বাড়ির সদর দরজা ঠেলিয়া বাহিরে আসিতেছে। প্রদীপ চাহিয়া দেখিল,—এ কি, সুধী! প্রদীপ চমকিয়া উঠিল,সুধী যে দিব্যি হাটিতে পারিতেছে! সন্ন্যাসীদের এবার হইতে দেখা পাইলেই প্রদীপ পায়ের ধূলা মাথায় ঠেকাইবে; চোদ্দ ঘণ্টার মধ্যে একটা কঙ্কালের কাহিল চেহারা এমন বলশালী হইয়া উঠিল! সুধী দরজাটা। বাহির হইতে ভেজাইয়া দিয়া সিড়ির উপর দাঁড়াইয়া রিষ্ট-ওয়াচে সময় দেখিয়া লইল, যেন তাহাকে এখুনি ট্রেন ধরিতে হইবে। হঠাৎ প্রদীপের সঙ্গে চোখোচাখি হইতেই সুধী অল্প-একটু হাসিল—সেই পরিচিত নিৰ্ম্মল হাসি, কতদিন এই হাসি সে দেখে নাই—তারপর ডান-হাতটা একটু তুলিয়া স্পষ্ট কহিল,—“চললাম, কথা বলবার এখন আর সময় নেই।” বলিয়াই সিড়ি হইতে নামিবার জন্য পা বাড়াইল। প্রদীপ বলিতে চাহিল : এই রাত করে কোথায় যাচ্ছি, ঠাণ্ডা লাগবে যে। কিন্তু সুধী-কে আর দেখা গেল না,ঐ রাস্তা ধবিয়া চলিয়াছে!
প্রদীপ চোখ কচলাইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল : “বাড়ির ভেতর থেকে কে বেরুল রে হরেন? দেখলি নে? মোটর নিয়ে ফের ষ্টেশনে চল। ও কি হেঁটেই যাবে নাকি?”
হরেন একটা লণ্ঠন জ্বালাইতে-আলাইতে কহিল,-“কে আবার গেল? পথের একটা কুকুর।”
ডাক্তারবাবু সিট-এ ঠেসান দিয়া তখনো ঝিমাইতেছেন; প্রদীপ তাহার হাত ধরিয়া এক ঝাঁকুনি দিয়া বলিয়া উঠিল : “আপনার ঘুমুবার জন্য খাট পেতে রেখেছি, উঠে আসুন দিকি।”
কথাটা ডাক্তারের কানে গেল না, কিন্তু ঝাঁকুনি খাইয়া উঠিয়া বসিলেন, এবং “এত রাতে জেগে থাকার অভ্যেস নেই” বলিয়া তাড়াতাড়ি গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িলেন।
অতিনিঃশব্দপদে উঠান পার হইয়া প্রদীপ বারান্দাতে উঠিল। বারান্দার কিনারায় দুইটি অপরিচিত লোক চুপ করিয়া বসিয়াছিল, প্রদীপকে দেখিয়া তাহারা চঞ্চল হইল না পর্যন্ত; প্রদীপ-ও তাহাদের কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না, জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন-ও বোধ করিল না। এই গহন নীরবতা তাহার সকল উদ্বেগের উপশম করিয়াছে; সুধী এখন একটু ঘুমাইয়াছে বলিয়াই কেহ একটিও শব্দ করিতেছে না;-বাতি নিভাইয়া সবাই তাহার ক্লান্তিমুক্ত নব-জাগরণের প্রতীক্ষা করিতেছে। প্রদীপ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া ডাক্তারকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,—“এই, বয়ে আসুন্। আলোটা একটু এদিকে, হরেন।”
চৌকাঠ ছাড়াইয়া ঘরে পা দিতেই প্রদীপ একেবারে বসিয়া পড়িল। যে-শোক প্রথম অভাবিত বিস্ময়ের আবেগে স্তব্ধ হইয়া ছিল তাহা আর সম্বরণ কব গেল না। প্রদীপ যেন মূর্তিমান ব্যর্থতাব মত আসিয়া দেখা দিযাছে,—নিরুদ্ধ শোক দিকে-দিকে অবারিত ও অজস্র হইয়া উঠিল! হরেন লণ্ঠনটা নামাইয়া রাখিয়া ছোট ছেলের মত কাদিয়া ফেলিল,—আর, প্রদীপ অঞলেশহীন শুষ্ক কঠোর চোখে সুধী-র মৃত্যু কলঙ্কিত মুখের দিকে চাহিয়া চোখের পলক আর ফেলিতে পারিল না।
ইঁদুরের মত নিঃশব্দে ডাক্তার সরিয়া পড়িতেছিলেন, অবনীবাবু স্বাভাবিক সংযতকণ্ঠে কহিলেন,—“অমন বোকার মতো কাঁদে না, হরেন। যা, ডাক্তারবাবুকে ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আয় গে—চারটাচুয়ান্নতে একটা গাড়ি আছে। ভদ্রলোকের এতটা কষ্ট হ’ল। অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না, প্রদীপ। ওঁর ভিজিটের টাকা দিয়ে দাও, এই নাও দেরাজের চাবি।”
ডাক্তারবাবু বারান্দায় আসিয়া কাহাকে বলিতেছিলেন,—“মফঃস্বলে আমরা সচরাচর বত্রিশ টাকা নিয়ে থাকি। কৰ্ত্তাকে বলবেন, ফেরুবার ভাড়াটা যেন সেকেণ্ড, ক্লাশের হয়।”
অবনীবাবু প্রদীপের হাতে তাহার দেরাজের চাবিটা গুঁজিয়া দিলেন বটে, কিন্তু প্রদীপ নড়িতে পারিতেছিল না। সে ব্যথিত হইবে না বিস্মিত হইবে, কঁদিবে না সান্ত্বনা দিবে, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া হতচেতন হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এই পৃথিবী, যাহার বিপুল মানুষের নির্ধারণের নহে, সেই পৃথিবীর কোথাও সুধী-র চিহ্ন রহিল না,-এই প্রকাণ্ড আকাশ হইতে সুধী-র দিবাস্বপ্নগুলি বিলুপ্ত হইয়া গেল,—একাকী সুধী কত দূরপথে যাত্রা করিয়াছে, তিমিরগহন রুক্ষপথে অনির্ণীতের সন্ধানে—ভাবিতে-ভাবিতে কি করিবে কিছুই ঠিক করিতে না পারিয়া, পকেট হইতে বাক্স বাহির করিয়া সে সিগারেট ধরাইল।
০৩. মানুষের শরীর বলিয়া যে-বস্তুটি আছে
মানুষের শরীর বলিয়া যে-বস্তুটি আছে, তাহার আবদার না রাখিলেই নয়। অতএব, অরুণাকেও একদিন চোখের জল মুছিয়া উঠিয়া বসিতে হইল। শুধু তাই নয়, মাসে হিসাবের অতিরিক্ত তেল খরচ হইয়াছে বলিয়া ,/;……1)2)3)।পনার অনুমতি চাই।”
প্রদীপ জানিত যে অরুণার চোখে জল আসিবে; তাই শোকাকে অযথা আর প্রশ্রয় না দিয়া কহিল,—“কলকাতায় গিয়ে ত’ চাকরির জন্য ফের পথে-পথে টো-টো করূতে হবে, দু’মুঠো জুটোতে হবে ত’! অনেক দিন থেকে গেলাম, চমৎকার থেকে গেলাম,—একেবারে নিখুঁত।”
প্রদীপের দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।
আঁচলে চোখের জল মুছিয়া অরুণা বলিলেন, “আমাদের ভুলে যেয়ো না, প্রদীপ।”
প্রদীপ তক্তপোষের একপ্রান্তে বসিয়া পড়িয়া কহিল,—“আপনারা আমাকে ভুলে গেছেন কি-না তা দেখবার জন্যে আমাকেও মাঝে-মাঝে এখানে আসতে হবে। আশা করি, সুধী দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায় নি।”
অরুণার দুই চক্ষু পরিপূর্ণ করিয়া আবার অশ্রু আসিল, এবার আর মুছিলেন না। প্রদীপের পিঠের উপর বাঁ-হাতথানি রাখিয়া অনুরোধ করিয়া কহিলেন,–“আরো দু’টো দিন থেকে যেতে পার না? তুমি চলে গেলে এ-ফাঁকা কি করে সইব?”