সেদিন রাত্রে কিছুতেই অজয়ের ঘুম আসিতেছিল না, পাশের নর্দামা হইতে মশারা দলবদ্ধ হইয়া তাহাকে আক্রমণ করিয়াছে। আত্মরক্ষা করিবার জন্য সে আলমারির মাথা হইতে বহুদিনের অব্যবহৃত মশারিটা নামাইল, কিন্তু প্রসারিত করিয়া দেখিল, সেটার সাহায্যে বংশানুক্রমে ইদুর গুলির ভূরিভোজন চলিয়া আসিতেছে। অগত্যা নিদ্রাদেবীকে তালাক দিয়া সে রাস্তায় নামিয়া আসিল। গলিটুকু পার হইয়া হারিস রোডে পড়িবে, বাঁক নিবার সময় সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, তাহাদের দোতলার বারান্দায় একটি মেয়ে রেলিঙে ভর দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। অজয় থামিল; বুঝিল, ইনিই নমিতা, নিদ্রাহীনা। স্তম্ভিত হইয়া কতক্ষণ সে দাঁড়াইয়া রহিল খেয়াল নাই, সে যেন তাহার চোখের সম্মুখে একটা নৈর্ব্যক্তিক আবির্ভাব দেখিতেছে। রাত্রির এই গাঢ় স্তব্ধতা যদি কোনো কবির কল্পনাস্বর্গ হইতে অবতরণ করিয়া আকার নিতে পারিত, তবে এই পবিত্র সমাহিত সুগন্তীর নারীমূর্তিই সে গ্রহণ করিত হয়ত। মুহূর্তে অজয়ের হৃদয়ে বেদনার বাষ্প পুঞ্জিত হইয়া উঠিল। এত বড় সৃষ্টি হইতে সম্পর্কহীন এমন একটি একাকিনী মূর্তি দেখিয়া বিস্ময়ের প্রাবল্যে যেন চলিবার শক্তিটুকুও সে হারাইয়া বসিয়াছে। চরিতার্থতাহীনতার এমন একটা সুস্পষ্ট ছবি সে ইহার আগে কোনো দিন কল্পনাও করিতে পারিত না।
পরের দিন রাত্রেও আবার সে বাহির হইয়া আসিয়া দেখিল, নমিতা তেমনি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া যেন এই বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে বিলীন হইয়া গেছে। আজ হঠাৎ কেন জানি না নমিতাকে দেখিয়া তাহার মনে নূতন আশা-সঞ্চার হইল, নমিতা যেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার একটি সুস্পষ্ট সহজ সঙ্কেত। এই নমিতাকে তাহাদের দলে লইতে হইবে। কৃত্রিম সংসাবের গণ্ডীতে জন্মান্ধ কূপমণ্ডুকের মত সঙ্কীর্ণ স্বার্থ লইয়া দিনযাপন করিলে তাহার চলিবে না; কর্মে, শিক্ষায়, চরিত্রমাধুর্যে তাহাকে বলশালিনী হইতে হইবে। সেই সুষুপ্ত মধ্যরাত্রিতে অবারিত আকাশের নীচে নমিতার প্রতি অজয় এমন একটি সুদূববিস্তৃত সহানুভূতি অনুভব করিল যে, যদি তাহার শক্তিতে কুলাইত, তখনি তাহাকে ঐ অবরোধের শাসন হইতে মুক্ত করিয়া দৃপ্ত বিদ্রোহিনীর বেশে পথের প্রান্তে নামাইয়া আনিত।
ছোট মেয়েটা যথারীতি চেঁচাইতে সুরু করিয়াছে। নমিতা ছুটিয়া গিয়া যথাপূৰ্ব্ব মেয়েটাকে কোলে নিয়া প্রবোধচেষ্টায় পাইচারি আরম্ভ করিল। নমিতা যে সামান্য সংসার কর্তব্যসাধিকা এই সত্যটি অজয়ের চোখে এখন সহসা উদঘাটিত হইল দেখিয়া তাহার চমক ভাঙিল। তুচ্ছ সন্তানপালন কি তাহাকে মানায়? বাঙলাদেশে তাহার জন্য ঝাঁকেঝকে মেয়ে আছে। নমিতা সর্ববন্ধনমুক্তা সর্বদায়িত্বহীনা বিজয়িনী।
তাহার পরদিন অজয় সুমিতাকে নিয়া পড়িল। নমিতা কিছু পড়াশুনা করে কি না, এইটুকু জানিতেই তাহার প্রবল ঔৎসুক্য হইয়াছে—সুমি ইহার উত্তরে যাহা বলিল তাহা স্বীকার করিতে গেলে তাহার দিদিকে কালিদাসের চেয়েও বড় পণ্ডিত বলিতে হয়, কিন্তু দিদির প্রতি সুমির এই প্রশংসমান পক্ষপাতিত্বে অজয় বিশ্বাস করিল না।
আলমারি হইতে একখানা বই বাহির করিয়া বলিল,-“এ বইখানা তোমার দিদিকে পড়তে দিয়ে এসো, কেমন?”
সুমি ঘাড় নাড়িয়া কহিল,—“দিদি আমার মত বানান করে পড়ে না, একনাগাড়ে পড়তে পারে। আমি যাচ্ছি এখুনি।”
অজয় সুমিকে ডাক দিয়া ফিরাইল, প্রায় কানে কানে কহিবার মত করিয়া বলিল,-“বইটা কে দিয়েছে বলে না যেন, বুঝলে?”
০৮. সুমির সঙ্গে অজয়
সুমির সঙ্গে অজয় লুকোচুরি খেলিতেছিল। আত্মরক্ষা করিতে সে এক-এক লাফে তিনটা করিয়া সিড়ি ডিঙাইয়া উপরে উঠিতেছে, মাঝপথে হঠাৎ নমিতাকে নামিতে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি বলিয়া বসিল,—“আমি এই দরজার আড়ালে গিয়ে লুকোচ্ছি, সুমি খুজতে এলে ভুল পথ দেখিয়ে দিয়ো।” বলিয়া অজয় দরজার পিছনে আত্মগোপন করিল। দুইটা দুয়ার যেখানে আসিয়া মিশিয়াছে তাহারই সামান্য ফাঁক দিয়া সে দেখিতে পাইল, নমিতা নীচে না নামিয়া সুমিকে ভুল সংবাদ দিবার জন্য সেইখানে নিস্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। প্রায় মিনিট দুই কাটিল, নমিতার নড়িবার নাম নাই।
সুমি হঠাৎ চীনে-বাদাম-ওলার ডাক শুনিয়া যুদ্ধে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিয়া রোয়াকে দাঁড়াইয়া ততক্ষণ বাদাম চিবাইতেছে-সে-খবর ইহাদের কানে পৌঁছাইবার সম্ভাবনা ছিল না। জয়-দা যে তাহার আক্রমণের ভয়ে এমন সন্ত্রস্ত হইয়াছেন ও তঁাহার দুর্গ-দুয়ারে প্রহরী মোতায়েন রাখিয়াছেন, তাহা জানিলে সুমি নিশ্চয়ই এত অনায়াসে রণে ভঙ্গ দিত না।
আরো কিছুক্ষণ কাটিলে অজয় বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, নমিতা তখনো কুণ্ঠিতকায়ে সেইখানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। এমন একটা নিভৃত মুহুর্তে কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে পাশ কাটাইয়া অন্তর্হিত হইলেই সৌজন্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখানো হয় কি না, সেই বিষয়ে মনে মনে কোনো প্রশ্ন না তুলিয়াই অজয় আবার কহিল, “সুমি বোধ হয় কয়লার ঘরে আমাকে খুঁজতে গেছে। সত্যি, সেখানে গিয়ে লুকলে আমাকে ওর আর এ-জন্মে বার করা চলত না।”
এটা অবশ্য অত্যুক্তি, কেননা বর্ণসম্পদে অজয় এতটা হেয় নয় যে, একেবারে কয়লার উপমেয় হইয়া উঠিবে। তবু, অতিশয়োক্তিটার দরুণ একটা প্রত্যুত্তর পাইবার আশা আছে মনে করিয়া, অজয় নিজের গায়ের রঙ সম্বন্ধে এমন একটা বিনয় করিয়া বসিল। নমিতা স্বল্প একটু হাসিল, ঘোমটা টানিয়া একটু চঞ্চল হইয়া উঠিল এবং সরিয়া যাওয়া সমীচীন হইবে মনে করিয়া এক পা বাড়াইয়া আর যাইতে পারিল না।