নমিতাকে এক পা-ও নড়িবার অবকাশ না দিয়া প্রদীপ তাড়াতাড়িতে তাহাকে ঈষৎ স্পর্শ করিয়া বারান্দায় চলিয়া আসিল এবং দ্বিরুক্তি না করিয়া পেছন হইতে দরজাটা টানিয়া শিকল তুলিয়া দিল।
ডে-চেয়ারটায় বসিল বটে, কিন্তু ঘুম আসিবার নাম নাই। তাই বলিয়া অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া, অস্তমান চাঁদের দিকে চাহিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিবার মত দৌর্বল্য প্রদীপের ছিল না। চক্ষুর পাতা দুইটাকে জোরে চাপিয়াও নিদ্রাকে বন্দী করা যাইতেছে না— নানা পারম্পর্যহীন ছবি অন্তর-চক্ষুর সামনে ভাসিয়া উঠিয়া তাহাকে উদ্বস্ত করিয়া তুলিয়াছে। নমিতাদের ঘরের আলো কখন নিবিয়া গেল, তাহা টের পাওয়া মাত্রই প্রদীপের কেমন একটা বিশ্বাস হইল যে, নমিতারো দুই চোখে শুষ্ক, বেদনাহীন বিনিদ্রতা বিরাজ করিতেছে। প্রাচীরের ব্যবধানের অন্তরাল হইতে প্রদীপের আত্মা যেন নমিতার আত্মার স্পর্শ পাইল, সেই স্পর্শরসে স্নান করিতে করিতে অতলস্পর্শ নিদ্রার সমুদ্রে সে ডুবিয়া গেল।
সকালে চায়ের টেবিলে সুধী বলিল,-“কাল রাতে একটু জ্বরভাব হয়েছে। গাড়ি ইত্যাদি ঠিক করতে আজকেই তোমার কলকাতা গিয়ে কাজ নেই, প্রদীপ। চায়ের সঙ্গে এই দুটো ইনফ্লুয়েঞ্জা ট্যাবলেট খাচ্ছি—বিকেলেই মাথাটা ছাড়বে হয়ত। রাত্রের ট্রেনে যেয়ো।”
সেই জ্বরই সতেরো দিন পরে যখন ছাড়িল, তখন সুধী কাশ্মীর উত্তীর্ণ হইয়া যে-পথে পাড়ি জমাইয়াছে সে-পথ ঘুরিয়া-ফিরিয়া পুনরায় পৃথিবীতে আসিয়া সমাপ্ত হয় নাই। আবার এই ধূলার ধরণীতেই প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে—এমন একটা বৈচিত্র্যহীন পৌঁনঃপুন্যতে অভিসারিক আত্মা অমৰ্যাদা বোধ করে। সুধী আর এই মৃত্তিকায় ফিরিয়া আসিবে না, আকাশের অগণন তারার মধ্য হইতে সে একটিকে বাছিয়া লইয়া সেইস্থানে অবতীর্ণ হইবে; সেখানে নবজন্মের নবতর আস্বাদ পাইবে, নরদেহ লইয়া তাহা কল্পনা করিবারও তাহার সাধ্য ছিল না।
০৬. সুধীর তিরোধানে
সুধীর তিরোধানে সমস্ত সংসার ওলোটপালট হইয়া গেল। না আছে শৃঙ্খলা, না আছে শ্ৰী। সব চেয়ে আশ্চর্য এই, মানুষগুলিও তাহাদের মুখের চেহারার সঙ্গে সঙ্গে মনের চেহারাও বদলাইয়া ফেলিয়াছে। বাঁচিয়া থাকিয়া সংসারের এই অবস্থা দেখিলে, সুধী নিশ্চয়ই বনবাসী হইত।
নমিতা এখন এই সংসারে কায়াহীন ছায়ামাত্র—এখানে তাহার আর প্রয়োজন নাই, সে যেন তাহার জীবনের সার্থকতা হারাইয়া বসিয়াছে। নমিতা যেন একটা নিৰ্বাপিত প্রদীপ—অন্ধকারে তাহার নিৰ্বাসন। বিকাল-বেলা নমিতা বারান্দায় চুপ করিয়া বসিয়াছিল, পিঠের উপর ঘন চুল নামিয়া আসিয়াছে, বসিবার ভঙ্গীটিতে একটি অসহায় ক্লান্তি। এইবার নমিতা কি করিবে, কোথায় যাইবে, কিছুই ভাবিয়া কিনারা করিতে পারিতেছে না। এই সংসারে উপবাসী ভিক্ষুকের মত কৃপাপ্রার্থিনী হইয়া তাহাকে কাল কাটাইতে হইবে ভাবিয়া তাহার অসহায় মন সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। অথচ এই বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে এই সামান্য ক্ষুদ্র গৃহকোণটি ছাড়া তাহার পা ফেলিবার স্থানই বা কোথায়? স্বামীর কাছে অপ্রতিবাদ আত্মদানের ফাঁকে সে স্বামীকে ভালবাসিতে চেষ্টা করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেই প্রেম সন্তানস্নেহ দ্বারা রঞ্জিত হয় নাই। তাই সুধী-র মৃত্যুতে অরুণা শোক করিয়াছেন সুধী-রই জন্য, নমিতা শোক করিয়াছে তাহার নিজের জন্য, তাহার এই অবাঞ্ছিত নিরুপায় বৈধব্যের ক্লেশ ভাবিয়া। এই বৈধব্যপালনে সে না পাইবে আনন্দ, না-বা তৃপ্তি। কিন্তু ইহাকে লঙ্ঘন করিবার মত বিদ্রোহাচরণের উদ্দাম শক্তিও তাহার নাই। মাথা পাতিয়া এই কৃত্রিম অনুশাসনের অত্যাচার তাহাকে সহিতে হইবে।
প্রদীপ কখন যে নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা নমিতা টের পাইলে নিশ্চয়ই মাথার উপর ঘোম্টা টানিয়া দিত। সে দুই হাতে জানালার শিক্ ধরিয়া তেমনি বসিয়া রহিল। যেন দুই হাতে দুইটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা ঠেলিয়া ফেলিবার জন্য সে সংগ্রাম করিতেছে। নমিতার মূর্তিতে এই প্রতিকারহীন বেদনার আভাস দেখিয়া, প্রদীপের মন ম্লান হইয়া উঠিল। কণ্ঠস্বর আর্দ্র করিয়া সে কহিল,—“নমিতা, আমি চল্লাম।”
নমিতা চমকিয়া উঠিল। বেশবাস তাড়াতাড়ি পরিপাটি করিয়া প্রদীপের মুখে তাহার নামোচ্চারণ শুনিয়া, সে একটি ক্ষীণ রোমাঞ্চ অনুভব করিতে করিতে স্তব্ধ হইয়া রহিল। আজ সুধীর অবর্তমানে নমিতার পরিচয়—সে একমাত্র নমিতা-ই; প্রদীপ তাহাকে সম্বোধন করিবার আর কোন সংজ্ঞা খুঁজিয়া পাইল না। নমিতার ইচ্ছা হইল, অনেক কিছু বলিয়া নিজেকে একেবারে হালকা করিয়া ফেলে —এই অপরিমেয় স্তব্ধতার সমুদ্রে পড়িয়া সে একা-একা আর সাঁতার কাটিতে পারিতেছে না। প্রদীপ ও তাহার মধ্যে যে-পরিচয় নিবিড় হইয়া উঠিতেছিল, মৃত্যু আসিয়া তাহার মধ্যে অনতিক্রম্য বাধা বিস্তার করিয়া দিয়াছে। তাই নমিতা কোনো কথাই বলিতে পারিল না, স্বামীর অবর্তমানে প্রদীপের কাছে নমিতার পরিচয়—আর বন্ধু নয়, মৃত বন্ধুর বিধবা-বধু মাত্র,—দেহের সঙ্গে-সঙ্গে আত্মাকেও তাহার আজ নিমীলিত অবগুণ্ঠিত করিয়া রাখিতে হইবে। জগতে তাহার সত্তাহীনতাই এখন প্রধান সত্য।
নমিতাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া প্রদীপ কহিল,—“পারিবারিক সম্পর্কে তোমার নিকটে না থাকলেও আমি তোমার আত্মীয়, নমিতা। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের সংসার আজকাল পরিবারকে ছাড়িয়ে উঠেছে, সেখানে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়ের বাধা নেই। অতএব প্রয়োজন বোধ কবৃলে আমাকে কাজে লাগাতে কুণ্ঠা কোরো না। আমি আপাতত তোমাদের ছেড়ে চল্লাম বটে, কিন্তু হয়তো আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে। ট্রেনের সময় বেশি নেই; আচ্ছা, আসি। নমস্কার!” বলিয়া প্রদীপ দুই হাত জোড় করিয়া নমস্কার করিল।