নমিতা হাসিয়া উঠিল। ভারতের ভূস্বর্গে সশরীরে আরোহণ। করিতে পারিবে ভাবিয়া, আরেকটু হইলে সে ছোট খুকির মত হাততালি দিয়া উঠিত। স্বামীকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিল,—“কবে যাচ্ছি?”
সুধী-র উৎসাহ যেন উবিয়া গেছে। বিরসকণ্ঠে কহিল,—“যেদিন সুবিধে হবে।” পরে প্রদীপকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,-“তোমার সঙ্গে কাশ্মীর যাওয়ার আমার উদ্দেশ্যই ছিল আমার মনের এই সমস্যাকে পরিষ্কার করে তুলতে। যখন এ সম্বন্ধে তোমার কোনো সহানুভূতি নেই, তখন কাশ্মীর যাওয়া বন্ধ রইলো। বাকি জীবনটা এখানেই যা হোক্ করে কাটিয়ে দেব’খন।”
“জীবন-সম্বন্ধে তোমার এই দিব্যজ্ঞান দেখে বাধিত হ’লাম।” কিন্তু চাহিয়া দেখিল নমিতার মুখ চূণ হইয়া গেছে। আবহাওয়াটাকে হাল্কা করিবার জন্য, মুখে হাসি আনিয়া প্রদীপ কহিল,—“সুবিধে আমার কাল-ই হচ্ছে। কালকেই আমি সকালের ট্রেনে কল্কাতা গিয়ে গাড়ি-টাড়ি সব রিজার্ভ করে আসছি। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে এস বৌদি, কি-কি জিনিস কিনে নিতে হবে, তার একটা হিসেব করে’ নেওয়া দরকার। আমরা তীর্থ করূতে যাচ্ছি না যে, পথের কষ্টভোগকে আমরা স্বর্গারোহণের দাম বলে মেনে নেব। আমরা যাচ্ছি বেড়াতে পান থেকে চুণ খসলেই আমাদের মুস্কিল। রেলের কামরাটাকে আমরা একটা অতি-আধুনিক ড্রয়িংরুম করে’ ছাড়বো।”
নমিতার মুখ তবুও প্রসন্ন হইল না। একান্তে প্রদীপকে বলিবার জন্যই সে একটু নিম্নস্বরেই কহিল,—“মুখ থেকে কথা যখন একবার বেরিয়েছে তখন আর তার নড়চড় হবে না, দেখবেন।”
প্রদীপ জোর দিয়া বলিয়া উঠিল,—“বেশ তো, নাই বা গেল সুধী— তুমি আর আমি যাবো। তুমি তার জন্যে ভেবো না, কাশ্মীর হোক, লিলুয়া পর্যন্ত আমরা যাবোই,আমি আর তুমি।”
দেখিতে-দেখিতে তাহাদের দুই জনের আলাপ এত জমিয়া উঠিল যে, তাহারা এক সময়ে টাই-টেবিল খুলিয়া বধে মেইল ও লাহোর এক্সপ্রেসের স্পিড়-এর তারতম্য বাহির করিতে অঙ্ক কষিতে বসিল। সুধী কখন চেয়ার ছাড়িয়া বিছানায় গিয়া শুইয়াছে, তাহা নমিতা লক্ষ্য করিলেও প্রদীপের খেয়াল ছিল না; সে গল্প নিয়া এমন মাতিয়া উঠিয়াছে! নমিতা তন্ময় হইয়া কথা শুনিতেছিল, শ্রোত্রী হিসাবে তাহাকে কেহ কোনো দিন এত প্রাধান্য দেয় নাই—এই ক্ষণ-বন্ধুতাটি তাহার কাছে এত রমণীয় লাগিতেছিল যে, স্বাভাবিক সঙ্কোচ বিসর্জন দিয়া নিজের কথা কিছু বলিতে পারিলে তাহার তৃপ্তির শেষ থাকিত না।
সেই সুযোগ আসিল। প্রদীপ হঠাৎ সচেতন হইয়া কহিল, “নজের কথাই পাঁচ কাহণ বলে যাচ্ছি—আমার জীবন-ইতিহাসের আদ্যোপান্ত নেই, বৌদি। আমি একটা চলমান গ্রহ—কখনো-কখন বা কারো অচল উপগ্রহ হয়ে থাকি। তোমার বাপের বাড়ির কোননা বৃত্তান্তই জানা হ’ল না। বর্তমানের বন্ধুতাকে অতীত কালেও বিস্তৃত করে দিতে হয়। এই কথা মনে রাখা চাই বৌদি, যে, বহু আগেই আমাদের দেখা হ’বার কথা ছিল—হয় নি, সে একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা মাত্র।”
কি বলিবে নমিতা কিছু ভাবিয়া পাইল না। তবু কথা কহিবার অদম্য-উচ্ছাসে অসংলগ্ন ভাষায় যাহা সে বলিয়া চলিল, তাহা গুছাইয়া সংক্ষেপে এই:
নমিতার বাবা রঙুপুরে ওকালতি করিতেন। তাহার এক দাদা ছিল, বছর দুই আগে স্বদেশী করিতে গিয়া পুলিশের হাতে যে মার খাইয়াছিলেন, তাহাতেই মারা গিয়াছেন। সেই শশাকেই বাবা ভাঙিয়া পড়িলেন; সমস্ত সংসার ছত্রখান হইয়া গেল। বাবা ওকালতি করিয়া টের পয়সা জমাইয়াছিলেন, খুড়া-মহাশয় চালাকি করিয়া তাহাতে হাত দিলেন। মা ও তাহার ছোট বোনটি এখন তাহার কাকারই আশ্রিত। কাকা কলিকাতায় দালালি করেন, অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল নয়—তবে বাবার জমাননা পয়সা হাতড়াইয়া এখন একটু সুরাহা করিতে পারিয়াছেন। কাকার স্বভাব অত্যন্ত রুক্ষ, কাকিমা তাহারই সহধর্মিণী। সম্পর্কের দাবিতে গুরুজন হইলে কি হইবে, কাকার প্রতি নমিতার মন মোটেই প্রসন্ন নয়। মা’র প্রতি তাহাদের ব্যবহার ঠিক গুরুভক্তির পরিচায়ক হইয়া উঠে নাই। মা বিষয়বুদ্ধিহীন—এমন কেহ নাই যে, তাহাদের এই সম্পত্তি-সঙ্কটের সময় সাহায্য করে; মা যে কাকার আশ্রয় ছাড়িয়া অন্যত্র বাসা করিবেন, তদারক করিবার জন্য তেমন। আত্মীয় অভিভাবকও তাহাদের নাই। নমিতাকে ভালো ঘরে বিবাহ দিবার জন্য তাহার বাবার একান্ত অভিলাষ ছিল, সেই জন্য যথেষ্ট টাকাও রাখিয়া গিয়াছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাহার ভালো ঘরে বিবাহ হইয়াছে বটে, (এখানে নমিতা একটু হাসিল) কিন্তু পণের টাকা দিয়া বিবাহের যাবতীয় খরচেই নাকি বাবার বিত্ত প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। কাকা যে মা ও তাহার ছোট মেয়েকে এতদিন ভরণপোষণ করিতেছেন, তাহার টাকা নিশ্চয়ই ছাত ফুড়িয়া পড়িতেছে না। নমিতা মেয়ে হইয়া জন্মিয়া মা ও ছোট বোটির কাছে অপরাধী হইয়া আছে। এমন সুযোগ্য জামাই পাইয়া মা যে আত্মীয়-গৌরবে উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা তাহার সামান্য দিবাস্বপ্ন মাত্র।
হঠাৎ চেয়ার হইতে উঠিয়া নমিতা বলিল,—“যান, এক্ষুনি শুয়ে পড়ুন গে। আমি মার ঘরে যাচ্ছি। মা আবার এত রাত পর্যন্ত গল্প করেছি টের পেলে বকূবেন হয় তো।” বলিয়া নমিতা বারান্দার দরজা দিয়া চলিয়া যাইতেছিল, প্রদীপ তাহাকে বাধা দিল; কহিল, “তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি? মা’র বকুনি খাবার লোতে তুমি তোমার এই উত্তপ্ত সুখশয্যা অতিথিকে ছেড়ে দিয়ে যাবে, এতে সতীধর্মের অবমাননা হবে, বৌদি। বারান্দায় একটা ডেক্-চেয়ার দেখা যাচ্ছে, না? দাঁড়াও।”