খাওয়ার পরে শুইবার ঘরে আসিয়া সুধী নমিতাকে কহিল, —“তুমি মা’র কাছ আজ শোও গে; প্রদীপের সঙ্গে রাত্রে আমার ঢের পরামর্শ আছে।”
প্রদীপ প্রতিবাদ করিয়া উঠিল : “না বৌদি, অত আড়ম্বরে কজি নেই। খেয়ে-দেয়ে পরামর্শ করবার মতো ধৈৰ্য্য ও অনিদ্রা বিধাতা আমাকে দেননি। বুঝলে সুধী, স্ত্রীকে ত্যাগ করে বন্ধুকে শয্যার পার্শ্ব দেওয়ার আতিথ্য এ-যুগে অচল হয়ে গেছে। তোমাদের ঘরের পাশেই যে ছোট বারান্দাটুকু আছে, তাতেই একটা মাদুর বিছিয়ে দাও, আমি এত প্রচুরপরিমাণে নাক ডাকাবো যে, জানলাটা খুলে রাখলেও তোমাদের প্রেমগুঞ্জন শুতে পাব না। ভয় পাবার কিছুই নেই, সুধী। তা ছাড়া না-ঘুমিয়ে বসে-বসে কলম কাড়াব, আমি আজো তত বড় সাহিত্যিক হইনি।”
মাথা নাড়িয়া সুধী কহিল,—“না, এ-ঘরে আজ নমিতার শোওয়া হবে না, তোমার সঙ্গে আমার অনেক গোপন কথা আছে।”
প্রদীপ। কী গোপন কথা? কাশ্মীর যাওয়ার কথা তো? তোকে সোজাসুজি বলে রাখছি সুধী, বৌদি না গেলে আমি যাব
কখনো।
সুধী। অত দূরে যাবার নমিতার কোনো দরকার নেই।
প্রদীপ। আর, আমারই জন্যে যেন কাশ্মীরের সিংহাসন খালি পড়ে আছে। বৌদির সান্নিধ্যে সাত মাস থেকে তোর যদি হাঁপানি উঠে থাকে, তবে তোর সঙ্গে একদিন থেকে আমার হবে প্লুরিসি।
নমিতাকে ঘর হইতে হঠাৎ চলিয়া যাইতে দেখিয়া, সুধী গম্ভীর হইয়া কহিল,—“সত্যি প্রদীপ, বিয়ের পর এই একঘেয়েমি আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। আমি দিন কয়েকের জন্যে বিশ্রাম চাই, চাই বৈচিত্র্য।”
প্রদীপ জোর দিয়া কহিল,—“এ তোর অত্যন্ত বাড়াবাড়ি, সুধী। বিয়ে এত ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে এই যদি তোর ধারণা ছিল, তবে বিয়ে করা তোর পক্ষে নিদারুণ পাপ হয়েছে।”
সুধী। ধারণা আমার আগে ছিলো না। তাই বলে ভুলকে সংশোধন কবে না—আমি তত ভীরু নই। নমিতা আমাকে তৃপ্ত করতে পারে নি।
প্রদীপ। কিন্তু বিয়ের আগে এই নমিতার রূপ ও তার বাপের টাকা হোর নয়নতৃপ্তিকর হয়ে উঠেছিল—তুই লোভী! বিয়ে করে’ ফেলে নমিতার ওপর বীতরাগ হওয়া নীতিতে তো বটেই, আইনেও দণ্ডনীয় হওয়া উচিত।
সুধী। তা আমি বুঝি। তাই প্রকাশ্যে আমি আমার এই ঔদাসীন্যের পরিচয় দিতে সব সময়েই ক্লেশ বোধ করেছি। আমি নমিতাকে ভালোবাসি না এমন নয়, কিন্তু ভালো লাগে না। আমার রুচির সঙ্গে ওর মিল নেই।
প্রদীপ। সেজন্যে নমিতাকে দায়ী কলে অন্যায় হবে। তোর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ওর ব্যক্তিত্বকে সঙ্কুচিত করে রাখার চেয়ে তাকে একটা স্পষ্ট ও উজ্জ্বল মূর্তি দেওয়ার চেষ্টা করাই উচিত মনে করি। মোট কথা জানিস কি সুধী, এই সব জায়গায় স্বামীকে তার অহঙ্কারের চূড়া। থেকে নেমে আসতে হয় স্ত্রীর সঙ্গে এক সমতল ভূমিতে,নইলে সঙ্গতির আর আশা নেই। তুই যেমন আপশোষ করছি, নমিতাও তেনি হয় তো তার ভাগ্যকে ভৎসনা করূছে। ভাবছে, কেন সাহিত্যিককে বিয়ে কলাম—এর চেয়ে একটি গৃহস্থকেরানি শতগুণে লোভনীয় ছিল। বিয়ের অপর নামই হচ্ছে স্ত্রী-পুরুষের শারীরিক একটা রফা। সন্ধির সর্ত ভাঙতে গেলেই আসে সামাজিক অশান্তি; আমরা সত্য লোক, ওটাকে এই জন্যেই এড়িয়ে যেতে চাই যে, অশান্তিটা কালক্রমে মনেও সংক্রামিত হয়। ভুল সংশোধন করার অর্থ আরেকটা ভুল করে বসা নয়। বিয়েটা দুইটা জীবনের সঙ্গে সমাজকে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে ভাঙার চাইতে জোড়াতালি দিতে গেলে অগৌরব হয় না। ডিভোর্সের আমি পক্ষপাতী,—কিন্তু ভালো লাগে না’ এই ওজুহাতকেই যদি বিবাহচ্ছেদের প্রধান কারণ বলে স্বীকার করা যায়—তা হ’লে পৃথিবীতে আত্মহত্যাও অত্যন্ত সুলভ হয়ে উঠবে। নমিতা তেমন লেখা-পড়া শেখেনি, রাজধানীর আবহাওয়ায় তার অঙ্গসজ্জা রাজসংস্করণ লাভ করেনি বা সে স্নায়ুহীন কবিপ্রিয়া না হয়ে সংসারকৰ্ম্মক্ষমা গৃহিণী হতে চায়—এই যদি তার ক্রটির নমুনা হয়, তবে বিয়ের আগে তোরই সাবধান হওয়া উচিত ছিলো, এখন তোর কাজ হচ্ছে নমিতাকে তোর উপযুক্ত করে তোলা।
সুধী। যে-কাজে আনন্দ নেই, সে-কাজে আমার মন ওঠে না। আচ্ছা এক কাজ করা যায় না? বাঙলা-সমাজ আঁৎকে উঠবে হয় তো।
প্রদীপ। কি?
সুধী। ধ আমি যদি আজ নমিতাকে ত্যাগ করি—হ্যাঁ, অন্য কোনো কারণে নয়, খালি তাকে আমার ভালো লাগে না বলে— এবং তার বিস্ময়ের ভাবটুকু কাটতে না কাটতেই, যদি তুই ওকে লুফে নিস—ব্যাপারটা কেমন হয়?
এমন একটা গুরুতর কথার উত্তরে কেহ যে এত জোরে হাসিয়া উঠিয়া প্রশ্নটাকে ব্যঙ্গ করিবার সাহস দেখাইতে পারে, তাহা সুধীর জানা ছিল না। তাহার মনে হইল, কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে যেন কি-একটা অপরাধ করিয়াছে। নমিতা কি-একটা কাজে বারান্দা দিয়া যাইতেছিল, প্রদীপ ডাকিয়া উঠিল : “সঙ্গে তুমি কি কি জিনিস নেবে, তার একটা ফর্দ আজ এক্ষুনি করে ফেলতে হবে। লেপ দু’খানা হলেই চলবে—লেপ গায়ে দিয়ে ট্রেনে ট্র্যাভেল করার মত সুখ আর নেই। শুনে যাও, বৌদি।”
“আস্চি”—বলিয়া নমিতা অন্তর্হিত হইতেই প্রদীপ কহিল, “কাশ্মীর ছেড়ে কাকে গেলেই ভালো করতিস, সুধী।”
অল্পক্ষণ পরেই নমিতা আসিল, তাহার সংসারের সব কাজ সমাধা হইয়াছে। প্রদীপ কহিল,—“যাবে তো, কিন্তু তোমার অনেক কাজ করতে হবে, মনে থাকে যেন। চা করে দেবে, গাড়ি ধবার সময়। প্ল্যাটফর্মে তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে, ভুলে লাগেজের গাড়িতে উঠে পড়বে না, গাড়ির ঝাঁকুনির টাল সামলাতে গিয়ে শেকল টেনে দেবে না, কলিশান্ হ’লে বাড়ির জন্যে মন-কেমন করূলে জরিমানা দেবে।”