প্রদীপ। তোমাকে সঙ্গে নেবে না কেন?
নমিতা। সে-প্রশ্ন আমি তাকে করেছিলাম। তিনি বল্লেন, “আমি বিশ্রাম করতে যাচ্ছি, সম্ভব হয় তো প্রদীপের সঙ্গে উপন্যাসটা শেষ করে ফেলব।
প্রদীপ। তুমি গেলে তার বিশ্রামের ব্যাঘাত হবে কেন? নমিতা। প্রথমত, আমি গেলে অনৈক্য ঘটবে, দ্বিতীয়ত, তার সাহিত্য-সাধনা সিদ্ধ হবে না।
কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই নমিতা বুঝিল, তাহাদের গোপন মনোমালিন্যের এই ইতিহাসটুকু ব্যক্ত না করিলেই ভালো হইত। কিন্তু তাহার উত্তরে প্রদীপ যাহা বলিয়া বসিল, তাহাতেও তাহার লজ্জা কম হইল না। প্রদীপ কহিল,—“তোমাকে একা ফেলে রেখে আমি ওর সঙ্গী হ’ব আমাকে ও এত বোকা ভাবলে কিসে? তোমার সান্নিধ্যে ও যদি শ্রান্ত হয়ে থাকে, তা হলে ওর নৈকট্যে আমাকে সন্ন্যাসী হতে হবে নিশ্চয়।” বলিয়া কথাটাকে লঘু করিবার চেষ্টায় সে হাসিয়া ফেলিল। কিন্তু নমিতা আর কোন কথাই কহিতে পারিল না, ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। মনে হইল তাহাদের দুর্লক্ষ্য গোপন বেদনাটা প্রদীপের চোখে ধরা পড়িয়াছে। ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই তাহার কথায় এমন স্পষ্টতা আসিয়াছে। ইহা নমিতার অভিপ্রেত ছিল না। স্বামীর কাছে কবে ও কেমন করিয়া যে সে তাহার রহস্য-মাধুৰ্য হারাইয়াছে, এমন নিবিড় মিলনে কবে যে অবসান ঘটিয়া অবসাদ আসিল, তাহা নির্ধারণ করিবার মত জ্যোতির্বিদ্যা নমিতার জানা ছিল না। নমিতাকে সুধী যে-পরিমাণ স্নেহ করে তাহার বিশেষণ দিতে গেলে অপর্যাপ্ত বলিতে হয়, অথচ নমিতাকে তাহার ভাল লাগে না—এই মনস্তত্ব বুঝিবার মন তাহার নাই। এই বেদনাটি মনেমনে লালন করিবার অবকাশে নমিতার মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, একদিন স্বামীর চক্ষে সে এত মহিমা ও মর্যাদা লইয়া উদ্ভাসিত হইবে, যাহার তুলনায় তাহার কল্পনাকায়া সাহিত্য-লক্ষ্মী নিত, নিরাভরণ। তাহারই জন্য সে স্বামীর কাছে মনে-মনে একটি শিশু কামনা করিয়াছে। এবং এই কামনার ভুল ব্যাখ্যা করিয়া স্বামী তাহাকে ভাবিয়াছেন গ্রাম্য, স্কুল। স্বামী তাহাকে বলিতেন,—“তুমি যে আমার স্ত্রী এই কথা সব সময়েই মনে রাখতে হয় বলে আমার ভালো লাগে না।” অথচ, এই প্রকার কৃত্রিম বিবাহজাত মিলনকে মাধুৰ্যপূৰ্ণ করিয়া তুলিবার জন্য যে বিবাহের পরেও দীর্ঘকালস্থায়ী প্রণয়োপাসনার প্রয়োজন আছে, তাহা প্রথমে স্বামীই বিস্মৃত হইয়াছিলেন। প্রেমকে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য যে-অনন্যপরায়ণ প্রতীক্ষা দরকার, তাহার ধৈৰ্য্য হারাইতে স্বামীই দ্বিধা করেন নাই। আজ সহসা নমিতা তাহার কাছে আবিষ্কৃত হইয়া গেছে!
বাড়ি আসিবার পথটুকু শীঘ্রই ফুরাইয়া গেল। সুধী তখনো ফিরিয়া : আসে নাই। নমিতা আসিয়া শুধাইল,—“মা বল্লেন, আপনার চা এখন নিয়ে আসবে?”
প্রদীপ কহিল,—“মাকে বোলো, এখন চা খেলে আমার ক্ষুধার অকালমৃত্যু ঘটবে।”
নমিতা হাসিয়া বলিল,—“রাতের খাওয়া হতে আমাদের বাড়িতে বেশ দেরি হয়, অতএব চা খেলে আপনার ক্ষুধা মরে গিয়েও ফের নবজীবন লাভ করবার সময় থাকবে।”
প্রদীপ কহিল,—“যদিও ক্ষুধাকে বাঁচিয়ে রাখবার ধৈৰ্য্য আমার আছে, তবু যখন বলছে, নিয়ে এস। দেখো, অতিমাত্রায় অতিথিপরায়ণ হ’য়ো না। অসুখ করিয়ে শেষে সেবার বেলায় ছুটি নেবে, সেটা। আতিথ্যের বড়ো নিদর্শন নয়।”
রাত্রের খাওয়ায় দেরি হয় বটে, কিন্তু সকলে একসঙ্গে বসিয়া খায়— একই চতুষ্কোণ টেবিলের চারধারে চেয়ার পাতিয়া। দৃশ্যটা দেখিয়া প্রদীপ মুগ্ধ হইয়া গেল। পারিবারিক প্রীতির এই দৃষ্টান্তটির মধ্যে সে নরনারীর সমানাধিকারের সঙ্কেত পাইল। এত আনন্দ করিয়া, এত পরিতৃপ্তির সঙ্গে সে কোনোদিন আহার করিয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইল না। আহাৰ্য্য বস্তুগুলি অরুণাই বটিয়া দিতেছিলেন, স্বাভাবিক সঙ্কোচের বাধা সরাইয়া বন্ধু নমিতাও তাহার অভিভাবকদের সম্মুখে সামান্য প্রভা হইয়া উঠিয়াছে, কথোপকথনের ফাঁকে-ফাঁকে উমার কলহাস্য বিরাম মানিতেছে না। নানা বিষয় নিয়া কথা হইতেছে—ভারতবর্ষের পরাধীনতা হইতে সুরু করিয়া গো-মাংসের উপকারিতা পৰ্যন্ত; সবাই সাধ্যমত টিপ্পনি কাটিতেছে, এবং অবনীবাবু তাহার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যের মুখোস খুলিয়া যেই একটু রসিকতা করিতেছেন, অমনি সবাই সমস্বরে উচ্চহাস্য করিয়া নিজের নিজের পরিপাক-শক্তিকে সাহায্য করিতেছে। প্রদীপ যে এই বাড়িতে একজন আগন্তুক অতিথিমাত্র, তাহা তাহাকে কে মনে করাইয়া দিবে? সামান্য খাইবার মধ্যে যে এত সুখ ছিল, মানুষের হাসি যে সত্যই আনন্দজনক,–এই সব স্বতঃসিদ্ধ তথ্যগুলি সম্বন্ধে সে হঠাৎ সচেতন হইয়া উঠিল। অরুণা প্রদীপকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন,—“সব আমার নিজের হাতের রাধা, তোমার মুখে রুচছে ত’?” দাঁতের ফাঁক হইতে মাছের কাটা খসাইতে-খসাইতে অবনীবাবু কহিলেন,—“তুমি কি আশা কর তোমার এই প্রশ্নের উত্তরে প্রদীপ বলবে যে রুচছে না, ন্যাকার করছে? প্রদীপের সত্যবাদিতায় নিশ্চয়ই তুমি সুখী হবে না। ভদ্র হবার জন্যে কেন যে এ-সব মামুলি কথা বল তোমরা, ভেবে পাইনে।” উমা টিপ্পনি কাটিল,—“আর প্রদীপবাবু যদি ভদ্রতর হ’বার জন্যে বলেন যে স্বৰ্গসভায় সুধা খাচ্ছি, তা হলে তার সেই অতিশয়োক্তিকে তুমি সন্দেহ করূবে; তাতেও তুমি সুখী হবে না।” প্রদীপ কহিল,—“অতএব কোননা বাক্-বিস্তার না করে নিঃশব্দে খেয়ে চলাই আমার পক্ষে ভদ্রতম হবে।”