- বইয়ের নামঃ কাকজ্যোৎস্না
- লেখকের নামঃ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
কাকজ্যোৎস্না
০১. ঘড়িটা বুঝি ঠিকমত চলিতেছে না
ঘড়িটা বুঝি ঠিকমত চলিতেছে না। দুইটা-কুড়িতে কলিকাতার ট্রেন আসিবে। সেই গাড়িতেই প্রদীপের ফিরিবার কথা। আসিয়া পৌঁছিলে হয়?
অরুণা স্বামীর মুখের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “ষ্টেশনে গাড়ি থাকবে ত’?”
স্বামী ঘরের মধ্যে অস্থির হইয়া পাইচারি করিয়া বেড়াইতেছিলেন, স্ত্রীর কথায় একটু থামিয়া একটা শোকাতুর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শুধু কহিলেন,—“আর গাড়ি!”
সেই স্তব্ধ-স্তম্ভিত ঘরে কথার অর্থটা স্পষ্ট হইয়া উঠিল। বাবোটা বাজিয়া ঘড়ির ছোট কাটাটা যেন আটকাইয়া গেছে,—সুধীর জীবনে দুইটা-কুড়ি বুঝি আর বাজিল না! প্রদীপের ফিরিয়া আসিবার আগেই প্রদীপ নিভিবে।
আকাশ ভরিয়া তারা জাগিয়াছে, কোটি কোটি জগৎ, কোটি কোটি জীবন! সমস্ত আকাশ ব্যাপিয়া কি বিস্তীর্ণ পথ, কি অপরিমেয় ভবিষ্যৎ! অবনী বাবু জানালা দিয়া বাহিরে চাহিলেন; রাস্তায় দূরে বাতি-থামের উপর একটা লণ্ঠন জ্বলিতেছে শুধু। সুষুপ্ত, প্রশান্ত রাত্রি।
ঘর ঠাণ্ডা রাখিবার জন্য সুধী-র শিয়রের কাছাকাছি পিলসুজের উপর মাটির বাতি জ্বালানো। সুধী বুঝি একটু চোখ চাহিল। অরুণা তাড়াতাড়ি ছেলের আরো নিকটে ঘেঁষিয়া আসিতে-আসিতে স্বামীকে কহিলেন,—“সলতেটা একটু বাড়িয়ে দাও শিগগির। সুধী কি যেন চাইছে।”
তারপর ছেলের আর্ত মলিন মুখের কাছে মুখ আনিয়া কোমলতর কণ্ঠে ডাকিলেন,—“সুধী, বাবা, কিছু বলবে?”
সুধী নিঃশব্দতার অপার সমুদ্রে ডুবিতেছে; জিহ্বায় ভাষা আসিল না,—দুৰ্বল ডান-হাতখানা মা’র কোলের কাছে একটু প্রসারিত করিয়া দিয়া কি যেন ধরিতে চাহিল।
অরুণা কহিলেন,—“এ পাশে একটু সরে এস বৌমা, সুধী বুঝি তোমাকে খুঁজছে।”
নমিতা স্বামীর পায়ের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল,—গভীর রাত্রির যে একটি প্রশান্তিপূর্ণ অনুচ্চারিত বাণী আছে, নমিতা তাহারই আকারময়ী। শাশুড়ির কথা শুনিয়া নমিতা নূতনেত্রে কাছে আসিয়া আঁড়াইতেই অরুণা কহিলেন,—“এ-সময়ে আর লোকলজ্জা নয় মা, তোমার ঘোম্টা ফেলে দাও! সুধী! মিতা, তোর মিতা—এই দ্যাখ, কিছু বলবি তাকে?”
সুধী বোধ হয় একটু চেষ্টা করিল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে পারিল না।
ঘরভরা লোকজনের মধ্যেই নমিতা অবগুণ্ঠন অপসৃত করিয়া সজল চোখে স্বামীর বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া রহিল,–“কেহ না থাকিলে হয়ত সকল লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া অনেক কথা কহিত, হয়ত একবার বলিত : “আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইতেছ, কত দূরে? সেখানে কাহাকে সঙ্গী পাইবে? তুমি আমাকে ভুলিয়া থাকিয়, কিন্তু আমি তোমাকে ভুলিয়া থাকিব কি করিয়া?”
অরুণা নমিতাকে সুধীর পাশে বসাইয়া দিয়া তাহার ব্রীড়াকুণ্ঠিত করতলে মুমূর্ষু সন্তানের শিথিল হাতখানি অৰ্পণ করিলেন। নমিতা দেখিল হাতখানি ঠাণ্ডা, যেন অব্যক্ত স্নেহে সিক্ত হইয়া আছে! মনে পড়িল, মাত্র সাত মাস আগে এই হাতখানিরই কুলায়ে ভীরু পক্ষীশিশুর মত তাহার দুর্বল কমনীয় হাতখানি রাখিয়া, এক উজ্জ্বল দীপালোকিত সহস্রকলহাস্যমুখর উৎসব-সভায় সে সর্বাঙ্গে প্রথম পুলকসঞ্চার অনুভব করিয়াছিল। আজো বুঝি তাহাদের নূতন করিয়া বিবাহ হইতেছে। নমিতার আজ নববধুর বেশ—সে আকাশচারী মৃত্যু—প্রতীক্ষামগ্ন দুই চক্ষু মেলিয়া স্বামীর শয্যাপাশ্বে আসিয়া বসিয়াছে। তোমরা উলু দিতেছ না কেন? আলো নিভাইয়া দাও, রাত্রির এই প্রগাঢ়-প্রচুর, অন্ধকারকে অবিনশ্বর করিয়া রাখ!
মৃত্যু আসিতেছে, ধীরে, অতিনিঃশব্দপদে—নিস্তরঙ্গ নদীর উপরে প্রশান্ত গোধুলির মত! কেহ কথা কহিয়ো না, মৃত্যুর মৃদুপদপাত শুনিবার আশায় নিশ্বাস রোধ করিয়া থাক!
অবনীনাথ হেঁচাইয়া উঠিলেন : “জানলাটা খুলে দাও শিয়রের, পথ আটকে রেখ না।”
কে একজন শিয়রের জানালা খুলিয়া দিল। আরেকজন কহিল,—“আপনি অত অস্থির হবেন না মেলোমশাই।”
অবনীনাথ চলিতে-চলিতে হঠাৎ থামিলেন : “পাগল! অস্থির আর হ’তে পারি কই, সত্য! আমাদের শরীর এমন সব স্নায়ু দিয়ে তৈরি যে অস্থির সে হতেই শেখেনি। আমরা ত’ অর আগ্নেয়গিরি নই!” দুই-পা হাঁটিয়া আবার দাঁড়াইলেন : “শুনেছি ভগবান যোগে বসে আছেন সমাহিত হয়ে, আর প্রকৃতি রাজ্য চালাচ্ছেন; বিধাতাকে আমি দুষবো না। আমি স্থির, হয়ত ভগবানেরই মতো। আমি ভাবছি ছেলে মরেছে বলে আমি বড় জোর একদিন কোর্ট কামাই কতে পাব —আমাকে একটা সাত-লাখ টাকার মোকদ্দমার রায় লিখতে হবে। আমি ভাবছি, পশু আমার লাইফ-ইসিয়োরেন্স-এর প্রিমিয়াম পাঠাবার শেষ তারিখ। আমার কি অস্থির হওয়া চলে?”
মধ্যরাত্রির মুহূর্তগুলি মন্থর হইয়া আসিয়াছে,—এত নিঃশব্দতা বুঝি সহিবে না। আত্মীয়-পরিজনের অন্ত নাই,—সবাই প্রশস্ত ঘরে রোগীর পরিচর্যায় নিযুক্ত। এখন সবাই সেবাশুশ্রুষা পরিত্যাগ করিয়া রোগীকে ঘিরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে—শেষনিশ্বাস-পতনের প্রতীক্ষায়। পরিবারের শিশুগুলি অন্য ঘরে দাসীর তত্ত্বাবধানে রহিয়াছে,–কেহ ঘুমাইয়া পড়িয়া গত রাত্রে শোনা পথিক-রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখিতেছে, কেহ বা বসিয়া আপন আপন মা’র কথামত অর্থহীন অসম্পূর্ণ ভাষায় অচেনা ভগবানের কাছে অসম্ভব প্রার্থনা করিতেছে। সমস্ত ঘরে সুগভীর শান্তি বিরাজমান। অবনী বাবুর লঘু পদশব্দ ছাড়া কোথা হইতেও একটি অস্ফুট কোলাহল হইতেছে না। সৃষ্টি যেন গতিবেগ রুদ্ধ করিয়া একটু দাঁড়াইয়াছে!