অপূর্ব ভাষণ দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেটি সাহিত্যধর্ম নামে ছাপা হল প্রবাসীতে। মূল কথা যা বলেছিলেন সেদিন, তা যেন আজকের দিনের সাহিত্যের পক্ষেও প্রযোজ্য।
‘রসসাহিত্যে বিষয়টা উপাদান, তার রূপটাই চরম।
মানুষের আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্র কালে কালে বিস্তৃত হতে থাকে।… অতএব বিষয়ের বৈচিত্র্য কালে-কালে ঘটতে বাধ্য। কিন্তু যখন সাহিত্যে আমরা তার বিচার করি তখন কোন কথাটা বলা হয়েছে তার উপর ঝোঁক থাকে না, কেমন করে বলা হয়েছে সেইটের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিই। …
কয়লার খনিক বা পানওয়ালীদের কথা অনেকে মিলে লিখলেই কি নবযুগ আসবে? এই রকমের কোনো একটা ভঙ্গিমার দ্বারা যুগান্তরকে সৃষ্টি করা যায় এ মানতে পারব না। বিশেষ একটা চাপরাসপরা সাহিত্য দেখলেই গোড়াতে সেটাকে অবিশ্বাস করা উচিত। তার ভিতরকার দৈন্য আছে বলেই চাপরাপের দেমাক বেশি হয়। …আজকের হাটে যা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কালই তা আবর্জনা-কুণ্ডে স্থান পায়। … সাহিত্যের মধ্যে অপ্রকৃতিস্থতার লক্ষণ তখনি প্রকাশ পায়, যখন দেখি বিষয়টা অত্যন্ত বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। … বিষয়প্রধান সাহিত্যই যদি এই যুগের সাহিত্য হয়, তা হলে বলতেই হবে এটা সাহিত্যের পক্ষে যুগান্ত।’
কিন্তু আসল মর্মকথাটি কি?
‘রাজপুত্র বৈজ্ঞানিক নন—অর্থশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি—তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন বোধ করি চব্বিশ বছর বয়স এবং তেপান্তরের মাঠ। দুর্গম পথ পার হয়েছেন জ্ঞানের জন্যে নয়, ধনের জন্যে নয়, রাজকন্যারই জন্যে। এই রাজকন্যার স্থান ল্যাবরটরিতে নয়, হাটবাজারে নয়, হৃদয়ের সেই নিত্য বসন্তলোকে, যেখানে কাব্যের কল্পলতায় ফুল ধরে; যাকে জানা যায় না, যার সংখ্যা নির্ণয় করা যায় না, বাস্তব ব্যবহারে যার মূল্য নেই, যাকে কেবল একান্তভাবে বোধ করা যায়–তারি প্রকাশ সাহিত্যকলায়, রসকলায়। এই কলাজগতে যার প্রকাশ, কোনো সমজদার তাকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে না, তুমি কেন? সে বলে, তুমি যে তুমিই এই আমার যথেষ্ট। রাজপুত্রও রাজকন্যার কানে-কানে এই কথাই বলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের এই সাহিত্যধর্ম নিয়েও তর্ক ওঠে। শরৎচন্দ্র প্রতিবাদে প্রবন্ধ লেখেন বঙ্গবাণীতে—সাহিত্যের রীতি ও নীতি। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তও শরৎচন্দ্রকে সমর্থন করেন। শরৎচন্দ্র ও নরেশচন্দ্র তো প্রকাশ্যভাবেই আধুনিকতার স্বপক্ষে। শনিবারের চিঠি মনে করল, রবীন্দ্রনাথও যেন প্রচ্ছন্নরূপে আশীর্বাদময়। নইলে এমন কবিতা তিনি কেন লিখলেন?
‘নিম্নে সরোবর স্তব্ধ হিমাদ্রির উপত্যকাতলে;
উদ্ধে গিরিশৃঙ্গ হতে শ্রান্তিহীন সাধনার বলে
তরুণ নির্ঝর ধায় সিন্ধুসনে মিলনের লাগি
অরুণোদয়ের পথে।” সে কহিল, “আশীৰ্বাদ মাগি,
হে প্রাচীন সোবর। সরোবর কহিল হাসিয়া,
“আশীষ তোমার তরে নীলাম্বরে উঠে উদ্ভাসিয়া
প্রভাত সুর্যের করে; ধ্যানমগ্ন গিরি তপস্বীর
নিরন্তর করুণার বিগলিত আশীৰ্বাদ-নীর
তোমারে দিতেছে প্রাণধারা। আমি বনচ্ছায় হ’তে
নির্জনে একান্তে বসি, দেখি তুমি নির্বারিত স্রোতে
সঙ্গীত-উদ্বেল নৃত্যে প্রতিক্ষণে করিতেছ জয়
মসীকৃষ্ণ বিপুঞ্জ পথরোধী পাষাণ-সঞ্চয়
গূঢ় জড় শত্ৰুদল। এই তব যাত্রার প্রবাহ
আপনার গতিবেগে আপনাতে জাগাবে উৎসাহ।”
শুধু আশীর্বাদ নয়, বিপক্ষদলের শত্রুকে “মসীকৃষ্ণ” বলা, “জড়” বলা! অসহ্য। সুতরাং বেড়া-আগুনে পোড়াও সবাইকে। শ্রদ্ধা ভক্তি ভদ্রতা শালীনতা সব বিসর্জন দাও।
সুরু হল সে এক উদ্দণ্ড তাণ্ডব। “তাণ্ডবে তুষিয়া দেবে খণ্ডাইবে পাপ”। পাপটি খণ্ডে গেল, মহাপ্রভু জগাই-মাধাইকে কোল দিলেন। কংস পেয়ে গেল কৃষ্ণের পাদপদ্ম।
সুবাতাস বইতে লাগল আস্তে আস্তে। কটূক্তি ছেড়ে সদুক্তির চেষ্টা-চৰ্চা সুরু করল শনিবারের চিঠি। বিভূতিভূষণের আগমনেই এই বাঁক নিলে, বাঁকাকে সোজা করার সাধনা। আসলে রোষ অস্ত গেলেই রস এসে দেখা দেয়। শনিবারের চিঠিও ক্রমে-ক্রমে রোষের জগৎ থেকে চলে আসতে লাগল রসের জগতে। ‘পতন-রব্যুদয়-দুর্গম-পন্থা’ শেষ পর্যন্ত ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর-পন্থা’ বলেই মান পেল। ‘খোকা-ভগবান’ বা ‘গক্’ মান পেল মহাপুরুষপ্রবর নেতাজীরূপে! বিদ্রোহী নজরুল ইসলাম পেল উপযুক্ত স্বদেশপ্রেমীর বিজ্ঞাপন। ক্রমে-ক্রমে সে স্তুতিবাদের সংসারে দেখা দিতে লাগল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর। কিছুকালের জন্যে বা মানিক—মনোজ, বনফুল–এবং পরবর্তী আরো কেউ-কেউ। বস্তুত ইচ্ছে করলে ওদের সম্বন্ধেও কি অপভাষ রচনা করা যেত না? কিন্তু শনিবারের চিঠি হৃদয়ঙ্গম করল শুধু নিন্দা কোথাও নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় না; আর শুধু-প্রশংসা কোথাও নিয়ে গিয়ে পৌঁছে না দিলেও অন্তত হৃদয়ে এনে জায়গা দেয়। সেই তো অনেক। এমনিতেও সমালোচনা নয়, অমতি ও সমালোচনা নয়। তবে বৈরাচরণ না করে বন্ধুকৃত্য করাই তো শুভকর। আঘাত অনেকই তো দিয়েছি, এবার আলিঙ্গন দেয়া যাক। দেখিয়েছি কত পরাক্রান্ত শক্ত হতে পারি, এখন দেখানো যাক হতে পারি কত বড় অনিন্দ্যবন্ধু। সজনীকান্ত প্রীতির মায়াপাশে বাঁধা পড়ল। যার যেমন পুঁজি, জিনিসের সে সেই রকমই দাম দেয়। কিন্তু অন্তরে প্রীতি জন্মালে বোধ করি নিজেকেও দিয়ে দিতে বাধে না।
কল্লোল উঠে যাবার পর কুড়ি বছর চলে গেছে। আরো কত বছর চলে যাবে, কিন্তু ওরকমটি আর ‘ন ভূতো ন ভাবী’। দৃশ্য বা বিষয়ের পরিবর্তন হবে দিনে-দিনে, কিন্তু যে যৌবন-দীপ্তিতে বাংলা সাহিত্য একদিন আলোকিত হয়েছিল তার লয়-ক্ষয়-ব্যয় নেই—সত্যের মত তা সর্বাবস্থায়ই সত্য থাকবে। যারা একদিন সেই আলোকসভাতলে একত্র হয়েছিল, তারা আজ বিচিত্র জীবনিয়মে পরস্পরবিচ্ছিন্ন–প্রতিপূরণে না হয়ে হয়তো বা প্রতিযোগিতায় ব্যাপৃত—তবু, সন্দেহ কি, সব তারা এক জপমালার গুটি, এক মহাকাশের গ্রহতারা। যে যার নিজের ধান্দায় ঘুরছে বটে, কিন্তু সব এক মন্ত্রে বাঁধা, এক ছন্দে অনুবর্তিত। এক তত্ত্বাতীত সত্তা-সমুদ্রের কল্লোল একেক জন। বাহ্যত বিভিন্ন, আসলে একত্র। কর্ম নানা আনন্দ এক। স্পর্শ নানা অনুভূতি এক। তেমনি সর্বঘটে এক আকাশ, সর্বপীঠে এক দেবতা, সর্বদেহে এক অধিষ্ঠান। ‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।’ তাই সর্বত্র মহামিলন। ভেদ নেই, দ্বৈত নেই, তারতম্য নেই, সর্বত্র এক সনাতনের উপাসনা।