বিষণ্ণ মমতায় চোখের দৃষ্টিটি কোমল। তখন শৈলজা আনন্দ হয়নি, কিন্তু আমাদের দেখে তার চোখ আনন্দে জ্বলে উঠল। যেন এই প্রথম আলাপ হল না, আমরা যেন কত কালের পরিচিত বন্ধু।
কোথায় যাচ্ছেন? জিগগেস করলাম গোকুলকে।
এই রূপনন্দন না রসনন্দন মুখার্জি লেন। মুরলীবাবুর বাড়ি। মুরলীবাবু মানে সংহতি পত্রিকার মুরলীধর বসু।
মনে আছে বাড়িতে মুরলীবাবু নেই—কি করা—গোকুলের লাঠির ডগা দিয়ে বাড়ির সামনেকার কঁচা মাটিতে সবাই নিজের নিজের সংক্ষিপ্ত নাম লিখে এলাম। মনে আছে গোকুল লিখেছিল G. c.-তার নামের ইংরিজি আদ্যাক্ষর। সেই নজিরে দীনেশরঞ্জনও ছিলেন D. R.। কিন্তু গোকুলকে সবাই গোকুলই বলত, G.C. নয়, অথচ দীনেশরঞ্জনকে সবাই ডাকত, D.R.। এ শুধু নামের ইংরিজি আদ্যাক্ষর নয়, এ একটি সম্পূর্ণ অর্থান্বিত শব্দ। এর মানে সকলের প্রিয়, সকলের সুহৃৎ, সকলের আত্মীয় দীনেশরঞ্জন।
০৪. প্রকৃষ্টরূপে বাসি—প্রবাসী
কাঁচা মাটিতে নামের দাগ কতক্ষণ বেঁচে থাকবে?
গোকুলের পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বেরুল। কিন্তু তার ওষ্ঠে পৃষ্ঠে-ললাটে নিজেদের নাম লিখি কি দিয়ে? কলম? কারুরই কলম নেই। পেন্সিল? দাঁড়াও, বাড়ির ভিতর থেকে জোগাড় করছি একটা।
পেন্সিল দিয়ে সবাই সেই ভিজিটিং কার্ডের গায়ে নিজের নিজের নাম লিখে দিলাম। সেই ভিজিটিং কার্ডটি মুরলীদার কাছে এখনো নিটুট আছে।
মুরলীধর বসু ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের একজন সাদাসিদে সাধারণ ইস্কুল মাস্টার! নিরাড়ম্বর নিরীহ জীবন, হয়তো বা নিম্নগত। এমনিতে উচ্চকিত উৎসাহিত হবার কিছু নেই। কিন্তু কাছে এসে একটা মহৎ উপলব্ধির আস্বাদ পেলাম। অদম্য কর্ম বা উত্তঙ্গ চিন্তায় অপু নয়—আছে সুদূরবিলাসী স্বপ্ন। দীনেশরঞ্জনের মত মুরলীধরও স্বপ্নদর্শী। তাই একজন D. R. আরেকজন মুরলীদ।।
একদিকে কল্লোল, আরেক দিকে সংহতি।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দুটি মাসিক পত্রই একই বছরে একই মাসে এক সঙ্গে জন্ম নেয়। ১৩৩০, বৈশাখ। কল্লোল চলে প্রায় সাত বছর, আর সংহতি উঠে যায় দু বছর না পুরতেই।
কল্লোল বললেই বুঝতে পারি সেটা কি। উদ্ধত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা, সমস্ত বাধা-বন্ধনের বিরুদ্ধে নির্ধারিত বিদ্রোহ, স্থবির সমাজের পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আলোড়ন। কিন্তু সংহতি কি? সংহতি তো–শিলীভূত শক্তি। সত্ব, সমূহ, গণগোষ্ঠী। যে গুণের জন্যে সমধর্মী পরমাণুসমূহ জমাট বাঁধে, তাই তো সংহতি। আশ্চর্য নাম। আশ্চর্য সেই নামের তাৎপর্য।
এক দিকে বেগ, আরেক দিকে বল। এক দিকে ভাঙন, আরেক দিকে সংগঠন, একীকরণ।
আজকের দিনে অনেকেই হয়তো জানেন না, সেই সংহতিই বাংলা দেশে শ্রমজীবীদের প্রথমতম মুখপত্র, প্রথমতম মাসিক পত্রিকা। সেই ক্ষীণকায় স্বল্পায়ু কাগজটিই গণজয়যাত্রার প্রথম মশালদার। লাঙল, গণবাণী ও গণশক্তি—এরা এসেছিল অনেক পরে। সংহতিই অগ্রনায়ক।
এই কাগজের পিছনে এমন একজনের পরিকল্পনা ছিল যার নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তিনি জিতেন্দ্রনাথ গুপ্ত। আসলে তিনিই এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা। অমৃতবাজার পত্রিকার ছাপাখানায় কাজ করেন। ঢোকেন ছেলেবয়সে, বেরিয়ে আসেন পঞ্চাশ না পেরোতেই, জরাজর্জর দেহ নিয়ে। দীর্ঘকাল বিষাক্ত টাইপ আর কদর্য কালি ঘেটে-ঘেটে কঠিন ব্যাধির কবলে পড়েন। কিন্তু তাতেও মন্দা পড়েনি তার উদ্যমে-উৎসাহে, মুছে যায়নি তার ভাবীকালের স্বপ্নদৃষ্টি।
একদিন চলে আসেন বিপিন পালের বাড়িতে। তাঁর ছেলে জ্ঞানাঞ্জন পালের সঙ্গে পরিচয়ের সুতো ধরে।
বিপিন পাল বললেন, কি চাই?
শ্রমজীবীদের জন্যে বাংলায় একটা মাসিকপত্র বের করতে চাই।
এমন প্রস্তাব শুনবেন বিপিনচন্দ্র যেন প্রত্যাশা করেন নি। তিনি মেতে উঠলেন। এর কিছুকাল আগে থেকেই তিনি ধনিক-শ্রমিক সমস্যা নিয়ে লেখা আর বলা শুরু করেছেন। ইন্টারন্যাশন্যাল গ্রুপ-এর ম্যানিফেস্টোর (পৃথিবীর অন্যান্য মনীষীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও রোঁলারও দস্তখৎ আছে) ব্যাখ্যা করেছেন তার World situation and Ourselves বক্তৃতায়; ইংরিজিতে প্রবন্ধ লিখেছেন মানুষের বাঁচবার অধিকার—Right to Live নিয়ে। তিনি বলে উঠলেন : নিশ্চয়ই। এই দণ্ডে বের করুন, আর কাগজের নাম দিন সংহতি।
কিন্তু কাগজ কি চলবে?
কেন চলবে না? জিতেনবাবু কলকাতার প্রেস-কর্মচারী সমিতির উদ্যোক্তা, সেই সম্পর্কে তাঁর সহকর্মী আর সহ-সদস্যেরা তাকে আশ্বাস দিয়েছে, কাগজ বের হওয়া মাত্রই বেশ কিছু গ্রাহক আর বিজ্ঞাপন জুটিয়ে আনবে। সকলে মিলে রথের রশিতে টান দেব, ঠিক চলে যাবে।
কিন্তু সম্পাদক হবে কে?
সম্পাদক হবে জ্ঞানাঞ্জন পাল আর তার বন্ধু মুরলীধর বসু।
আর আফিস?
আফিস হবে ১ নম্বর শ্রীকৃষ্ণ লেন, বাগবাজার। কুণ্ঠিত মুখে হাসলেন জিতেনবাবু।
সেটা কি?
সেটা আমারই বাসা। একতলার দেড়খানা ঘরের একখানি।
সেই একতলায় দেড়খানা ঘরের একখানিতে সংহতির আফিস বসল। দক্ষিণচাপা গলি, রাস্তার দিকে উত্তরমুখো লম্বাটে ঘর। আলো-বাতাসের সঙ্গস্পর্শ নেই। একপাশে একটি ভাঙা আলমারি, আরেক পাশে একখানি ন্যাড়া তক্তপোশ। টেবিল চেয়ার তো দূরের কথা, তক্তপোশের উপর একখানা মাদুর পর্যন্ত নেই। শুধু কি দরিদ্রতা? সেই সঙ্গে আছে কালান্তক ব্যাধি। তার উপর সদ্য স্ত্রী হারিয়েছেন। তবু পিছু হটবার লোক নন জিতেনবাবু। ঐ ন্যাড়া। তক্তপোশের উপর রাত্রে ছেলেকে নিয়ে শোন আর দিনের বেলা কাশি ও হাঁপানির ফাঁকে সংহতির স্বপ্ন দেখেন।