যতদূর দেখছি, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ই বোধহয় আত্মোল্লেখে প্রথম শ্ৰী বর্জন করেন। এবং সে সব দিনে এমন অরসিকেরও অভাব ছিল না যে শ্রীহীন চারুকে নিয়ে না একটু ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছে।
আসলে সব চেয়ে সরল ও পরিচ্ছন্ন, নাম নামের আকারেই ব্যক্ত করা। নাম শুধু নামই। নামের মধ্যে নাম ছাড়া আর কিছুর নাম-গন্ধ না প্রকাশ পায়। শ্রী একেবারে বিশ্রী না হোক, নামের তে। বটেই, প্রসঙ্গেরও বহিভূত।
একদিন দুপুরবেলা বসে আছি—বা, বলতে পারি, কাজ করছিএকটি দীর্ঘকায় ছেলে ঢুকল এসে বিচিত্রা-আপিসে। দোতলায় সম্পাদকের ঘরে।
উপেনবাবু তখনো আসেননি। আমিই উপনেতা।
একটা গল্প এনেছি বিচিত্রার জন্যে হাতে একটা লেখা, ছেলেটি হাত বাড়াল।
প্রখর একটা ক্ষিপ্রতা তার চোখে-মুখে, যেন বুদ্ধির সন্দীপ্তি। গল্প যেন সে এখুনি শেষ করেছে আর যদি কাল বিলম্ব না করে এখুনি ছেপে দেওয়া হয় তা হলেই যেন ভালো হয়।
এই রইল—
ভঙ্গিতে এতটুকু কুণ্ঠা বা কাকুতি নেই। মনোনীত হবে কি না হবে সে সম্বন্ধে এতটুকু দ্বন্দ্ব নেই। আবার কবে আসবে ফলাফল জানতে, কৌতূহল নেই একরতি।
যেন, এলুম, লিখলুম আর জয় করলুম—এমনি একটা দিব্য ভাব।
লেখাটা নিলুম হাত বাড়িয়ে। গল্পটির নাম অতসী মামী। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক ভট্টাচার্য যিনি লিখতেন এ সে নয়। এ বন্দ্যোপাধ্যায়।
লেখাটা অদ্ভুত ভালো লাগল। উপেনবাবুও পছন্দ করলেন। গল্প ছাপা হল বিচিত্রায়। একটি লেখাতেই মানিকের আবির্ভাব অভ্যর্থিত হল।
মানিকই একমাত্র আধুনিক লেখক যে কল্লোল-ডিঙিয়ে বিচিত্রায় চলে এসেছে–পটুয়াটোলা ডিঙিয়ে পটলডাঙায়। আসলে সে কল্লোলেরই কুলবর্ধন। তবে দুটো রাস্তা এগিয়ে এসেছে বলে সে আরো ত্বরান্বিত। কল্লোলের দলের কারু কারু উপন্যাসে পুলিশ যখন। অশ্লীলতার ওজুহাতে হস্তক্ষেপ করে, তখন মানিক বোধ হয় শুক্তি-মগ্ন! এক যুগে যা অশ্লীল পরবর্তী যুগে তাই জোলো, সম্পূর্ণ হতাশাব্যঞ্জক।
বিচিত্রায় এসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্নিহিত হই। তখন তার পথের পাঁচালী ছাপা হচ্ছে—মাঝে-মধ্যে বিকেলের দিকে আসতেন বিচিত্রায়। যখনই আসতেন মনে হত যেন অন্য জগতের সংবাদ নিয়ে এসেছেন। সে জগতে প্রকৃতির একচ্ছত্র রাজত্ব—যেন অনেক শান্তি, অনেক ধ্যানলীনতার সংবাদ সেখানে। ছায়ামায়াভরা বিশালনির্জন অরণ্যে যে তাপস বাস করছে তাকেই যেন আসন দিয়েছেন হৃদয়ে—এক আত্মভোলা সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে তিনিও যেন সমাহিত, প্রসন্নগম্ভীর। প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য আত্মসংযোগ রেখেছেন বলে তাঁর ব্যক্তে ও মৌনে সর্বত্রই সমান স্বচ্ছতা, সমান প্রশান্তি। তার মন যেন অনন্তভাবে স্থির ও আবিষ্ট। মনের এই শুক্লধর্ম বা নৈর্মল্যশক্তি অন্য মনকে স্পর্শ করবেই। যে মানবপ্রীতির উৎস থেকে এই প্রজ্ঞা এই আনন্দ তাই তো পরমপুরুষার্থ। এই প্রীতিম্বরূপে অবস্থিতিই তো সাহিত্য। এই সাহিত্যে বা সহিত-বেই বিভূতিভূষণের প্রতিষ্ঠা। স্বভাবস্বচ্ছধবল নিশ্চিন্ত-নিস্পৃহ বিভূতিভূষণ।
এই বিভূতিভূষণের আওতায় এসে শনিবারের চিঠি তার সুর বদলাতে সুরু করল। অর্থাৎ সে স্তুতি ধরলে। এর আগে পর্যন্ত সে একটানা ঘৃণা-নিন্দা করেই এসেছে, পরের ছিদ্রদর্শনই তার একমাত্র দর্শন ছিল। চিত্তের ধর্মই এই, যখন সে যার ভাবনা করে, তখন তদাকারাকারিত হয়। আকাশ বা সমুদ্র ভাবলে মন যেমন প্রশান্ত ও প্রসারিত হয় তেমনি ক্লেদ ও কর্দম ভাবলে হয় দূষিত ও কলুষিত। যার শুধু পরের দোষ ধরাই ঝোঁক—এমন মজা–সে দোষই তাকে ধরে বসে। আর, ভাগ্যের এমন পরিহাস, যে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে সে-ই শেষে একদিন সেই অশ্লীলতার অভিযোগেই রাজদ্বারে দণ্ডিত হয়।
সব চেয়ে লাঞ্ছনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। সে এক হীনতম ইতিহাস। শনিবারের চিঠির হয়তো ধারণা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ আধুনিক লেখকদের উপর সম্পূর্ণ বীতরাগ নন-তাঁরই প্রশংসার আশ্রয়ে তারা পরিপুষ্ট হচ্ছে। এই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ির বিচিত্রাভবনে যে বিচার-সভা বসে তা উল্লেখযোগ্য। আধুনিক সাহিত্যের গতি ও রীতি নিয়ে যে তর্ক উঠেছে তার মীমাংসা নিয়েই সে সভা। মীমাংসা আর কি, রবীন্দ্রনাথ কি বলেন তাই শোনা।
দুদিন সভা হয়েছিল। প্রথম দিন শনিবারের চিঠি উপস্থিত ছিল না। দ্বিতীয় দিন ছিল। তার দলে অনেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন–মোহিতলাল, অশোক চট্টোপাধ্যায়, নীরদ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, গোপাল হালদার—তবে দ্বিতীয় দিনের সভায় ও-পক্ষে ঠিক কে-কে এসেছিলেন মনে করতে পারছি না। কল্লোল-দল দুদিনই উপস্থিত ছিল। আর অনপেক্ষদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী, প্রশান্ত মহলানবিশ, অপূর্বকুমার চন্দ, নরেন্দ্র দেব—আর সর্বোপরি অবনীন্দ্রনাথ।
কথা-কাটাকাটি আর হট্টগোল হয়েছিল মন নয়। এর কি কোনো ডিক্রি-ডিসমিস আছে, না, এ নিয়ে আপোষ-নিষ্পত্তি চলে? দল বেঁধে যদি সাহিত্য না হয়, তবে সভা করেও তার বিধি-বন্ধন হয় না।
চরম কথা বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, এদের লেখা যদি খারাপ তবে তা পড়ো কেন বাপু। খারাপ লেখা না পড়লেই হয়।
শুধু নিজের পড়েই ক্ষান্তি নেই, অন্যকে চোখে আঙুল দিয়ে পড়ানো চাই। আর তারি জন্যে মণি-মুক্তা অংশটিতে ঘন-ঘন ফোঁড় দিয়ে দেওয়া যাতে করে বেশ নিরিবিলিতে বসে উপভোগ করা চলে। প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপনটি এইরূপ : ‘অশ্লীলতার জন্য যাহারা শনিবারের চিঠির মণিমুক্তা অংশটি না ছিঁড়িয়া বাড়ী যাইতে পারেন না বলিয়া আপত্তি করেন তাহাদের জন্য মণিমুক্তা perforate করিয়া দিলাম।’ কেউ-কেউ আকর্ষণ বাড়াবার জন্যে পৃষ্ঠাগুলো আঠা দিয়ে এঁটে দেয়, কেউ-কেউ বা স্বচ্ছাবরণ জ্যাকেটে পুরে রাখে।