২৫. মীমাংসা সভা
কল্লোলের শেষ বছরে বিচিত্রায় চাকরি নিলাম। আসলে প্রুফ দেখার কাজ, নামে সাব-এডিটর। মাইনে পঞ্চাশ টাকা।
বহুবিত সাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিচিত্রার সম্পাদক। তার ভাগ্নে আদি পোস্ট-গ্রাজুয়েটে আমার সহপাঠী ছিল। সেই একদিন বললে, চাকরি করব কি না। চাকরিটা অপ্রীতিকর নয়, মাসিক পত্রিকার আপিসে সহসম্পাদকি। তারপর বিচিত্রার মত উচকপালে পত্রিকা-–যার শুনেছি, বিজ্ঞাপনের পোস্টার শহরের দেয়ালে ঠিক-ঠিক লাগানো হয়েছে কিনা দেখবার জন্যেই ট্যাক্সি-ভাড়া লেগেছিল একটা স্ফীতকায় অঙ্ক। কিন্তু আমরা নিন্দিত অতি-আধুনিকের দলে, অভিজাত মহলে পাত্তা পাব কিনা কে জানে। সাহিত্যের পূর্বগত সংস্কায়-মানা কেউ আছে হয়তো উমেদার। সে-ই কামনীয় সন্দেহ কি।
কিন্তু উপেনবাবু অবাক্যব্যয়ে আমাকে গ্রহণ করলেন। দেখলাম গণ্ডূষজলে সফরীরাই ফরফর করে, সত্যিকারের যে সাহিত্যিক সে গভীরসঞ্চারী! উপেনবাবুর দুই ভাই গিরীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় দুইজনেই আধুনিক সাহিত্যের সংরক্ষক ছিলেন। সুরেনবাবু তো সক্রিয় ভাবে অজস্র লিখেছেনও কল্লোল-কালিকলমে। গিরীনবাবু না লিখলেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন মজঃফরপুর সাহিত্য-সম্মিলনে। খানিকটা অংশ তুলে দিচ্ছি :
আজ সাহিত্যের বাজারে শ্লীল-অশ্নীল সুরুচিসম্পয়-রুচিবিগর্হিত চনার চুলচেরা শ্রেণীবিভাগ লইয়া যে আলোচনার কোলাহল জাগিয়াছে তাহা বহু সময়েই সত্যকার রুচির সীমা লঙ্ঘন করিয়া যায়। কুৎসিতকে নিন্দা করিয়া যে ভাষা প্রয়োগ করা হয় তাহা নিজেই কুৎসিত।।
অশ্লীলতা এবং কুৎসিত সাহিত্য নিন্দনীয়, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন। ইহা এমন একটা অদ্ভুত কথা নহে যাহা মানুষকে কুৎসিত কণ্ঠে শিখাইয়া না দিলে সে শিখিতে পারিবে না। কিন্তু আসল গোল হইতেছে শ্লীলতা এবং অশ্লীলতার সীমানির্দেশ ব্যাপার লইয়া। কে এই সীমা-নির্দেশ করিবে? …
এই তথাকথিত অশ্লীলতা লইয়া এত শঙ্কিত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। ছেলেবেলায় আমি একজন শুচিবায়ুগ্রস্ত নারীকে দেখিয়াছিলাম, তিনি অশুচিকে বাঁচাইয়া চলিবার জন্য সমস্ত দিনটাই রাস্তায় লক্ষ্য দিয়া চলিতেন, কিন্তু রোজই দিনশেষে তাহাকে আক্ষেপ করিতে। শুনিতাম যে, অশুচিকে তিনি এড়াইতে পারেন নাই। মাঝে হইতে তাহার লম্ফঝম্পের পরিক্রমই সার হইত। সাহিত্যেও এই অত্যন্ত অশুচিবায়ুরোগের হাত এড়াইতে হইবে। …
যাহা সত্য তাহা যদি অশুভও হয় তথাপি তাহাকে অস্বীকার করিয়া কোন লাভ নাই, তাহাকে গোপন করিবার চেষ্টা বৃথা! বরং তাহাকে স্বীকার করিয়া তাহার অনিষ্ট করিবার সম্ভাবনা কোথায় জানিয়া লইয়া সাবধান হওয়াই বিবেচনার কাৰ্য। …
মাসিকে সাপ্তাহিকে দৈনিকে আজ এই হাহাকারই ক্রমাগত শোনা যায় যে, বাঙলা সাহিত্যের আজ বড় দুর্দিন, বাঙলা-সাহিত্য জঞ্জালে ভরিয়া গেল—বাঙলা-সাহিত্য ধ্বংসের পথে দ্রুত নামিয়া চলিয়াছে। হাহাকারের এই একটা মস্ত দোষ যে, তাহা অকারণ হইলেও মনকে দমাইয়া দেয়, খামকা মনে হয় আমিও হাহাকার করিতে বসি। এই সভায় সমাগত হে আমার তরুণ সাহিত্যিক বন্ধুগণ, আমি আপনাদিগকে সত্য বলিতেছি যে, বাঙলা-সাহিত্যের অত্যন্ত শুভদিনে আপনাদের সাহিত্যজীবন আরম্ভ হইয়াছে, এত বড় শুভদিন বাঙলা-সাহিত্যের আর আসিয়াছিল কি না জানি না। বাঙলা-সাহিত্য-জননী আজ রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র—এই দুই দিকপালের জন্মদান করিয়া জগৎবরেণ্যা। জননীর পূজার জন্য যে বহু বঙ্গসন্তান, সক্ষম অক্ষম, বড় ও ছোট—আজ থরেথরে অর্ঘ্যের ভার লইয়া মন্দির-পথে উৎসুক নেত্রে ভিড় করিয়া চলিয়াছেন, এ দৃশ্য কি সত্যই মনোরম নহে?
উপেনবাবুই তার অভিমত ব্যক্ত করেন নি, না কোনো সাহিত্যসাহচর্যে না কোনো লেখায়-বক্তৃতায়। তাই কিছুটা সংকোচ ছিল। গোড়াতে। কিন্তু, প্রথম আলাপেই বুঝলাম, বিচিত্রার ললাট যতই উচ্চ হোক না কেন, উপেনবাবুর হৃদয় তার চেয়ে অনেক বেশি উদার। আর, সাহিত্যে যিনি উদার তিনিই তো সবিশেষ আধুনিক। কাগজের ললাটে-মলাটে যতই সন্ত্ৰান্ততার তিলকছাপা থাক না কেন, অন্তরে সত্যিকারের রসসম্পদ কিছু থাক, তাই উপেনবাবুর লক্ষ্য ছিল। সেই কারণে তিনি কুলীনে-অকুলীনে প্রবীণে-নবীনে ভেদ রাখেন নি, আধুনিক সাহিত্যিকদেরও সাদরে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বয়সের প্রাবণ্য তার হৃদয়ের নবীনতাকে শুষ্ক করতে পারেনি। আর যেখানেই নবীনতা সেখানেই সৃষ্টির ঐশ্বর্য। আর যেখানেই প্রতি সেখানেই রসম্বরূপ।
আর এই অক্ষয়-অক্ষুন্ন প্রীতির ভাবটি সর্বক্ষণ পোষণ করেছেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়—বাংলা-সাহিত্যের সর্বজনীন দাদামশায়। কল্লোলে তিনি শুধু লেখেনইনি, সবাইকে স্নেহাশীর্বাদ করেছেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের দুটি সাধ ছিল—প্রথম, ভক্তের রাজা হবেন, আর দ্বিতীয়, শুটকে সাধু হবেন না। কেদারনাথের জীবনেও ছিল এই দুই সাধপ্রথম, ঠাকুর রামকৃষ্ণের দর্শন পাবেন আর দ্বিতীয়, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হবেন। এই দুই সাধই বিধাতা পূর্ণ করেছিলেন তাঁর।
সজ্জা শোভা ও কারুকার্যের দিকে বিচিত্রার বিশেষ ঝোঁক ছিল। একেক সময় ছবির জমকে লেখা কুণ্ঠিত হয়ে থাকত, মনে হত লেখার চেয়ে ছবিরই বেশি মর্যাদা—অন্তশ্চক্ষুর চাইতে চর্মচক্ষু। লেখকের নামসজ্জা নিয়েও কারিকুরি ছিল। প্রত্যেক লেখার দু অংশে নাম ছাপা হত। লেখার নিচে লেখকের যে নাম সেটি লেখকদত্ত, তাই সেটি হীন, আর যেটি শিরোভাগে সেটি সম্পাদকদত্ত, তাই সেটি শ্ৰীযুক্ত। এর একটা তাৎপর্য ছিল। নামের আগে যে শ্রী বসে সেটা সমাস হয়ে বসে, তার অর্থ, নামধারী একজন শ্বসংশালী লক্ষ্মীমন্ত লোক। নিজের পক্ষে এই আত্মঘোষণটি। শিষ্টাচার নয়। তাই বিনয়বুদ্ধিবিশিষ্ট লোক নিজের নামের আগে এই শ্রী ব্যবহার করে না। সেই ব্যবহারটা অব্যবহার। কিন্তু পরের নামের বেলায় শ্রী যুক্ত করে দেয়াটা সৌজন্যের ক্ষেত্রে সমীচীন। পরকে সম্মান দেয়া সুখৈশ্বর্যবান আখ্যা দেওয়া ভদ্রতা, সভ্যতা, বিনয়বাক্যের প্রথম পাঠ। এই তাৎপর্যের ব্যাখ্যাতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর, এটি একটি যথার্থ ব্যাখ্যা।