সরোজকুমার রায় চৌধুরীও কল্লোলের প্রথমাগত। দৈনিক বাংলায় কথায় কাজ করত প্রেমেনের সহকর্মী হিসেবে। তার লেখায় প্রসাদগুণের পরিচয় পেয়ে প্রেমেন তাকে কল্লোলে নিয়ে আসে। প্রথমটা একটু লাজুক, গম্ভীর প্রকৃতির ছিল, কিন্তু হৃদয়বানের পক্ষে হৃদয় উন্মোচিত না করে উপায় কি? অত্যন্ত সহজের মাঝে অত্যন্ত সরস হয়ে মিশে গেল সে অনায়াসে। লেখনীটি সূক্ষ্ম ও শান্ত, একটু বা কোমলা। জীবনের যে খুঁটিনাটিগুলি উপেক্ষিত, অন্তরদৃষ্টি তার প্রতিই বেশি উৎসুক। কল্লোলের যে দিকটা বিপ্লবের সেদিকে সে নেই বটে, কিন্তু যে দিকটা পরীক্ষা বা পরীষ্টির সে দিকের সে একজন। এক কথায় বিদ্রোহী না হোক সন্ধানী সে। এবং যে সন্ধানী সেই সংগ্রামী। সেই দিক থেকেই কল্লোলের সঙ্গে তার ঐকপ্য।
মনোজ বসুও না লিখে পারেনি কল্লোলে। কল্লোলে ছাপা হল তার কবিতা-জসিমী ঢঙে লেখা। তার মেসের বিছানার তলা থেকে কবিতাটি লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল কবি ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মনোজের সঙ্গে পড়েছি এক কলেজে। মনের প্রবণতায় এক না হলেও মনের নবীনতায় এক ছিলাম। কল্লোল যে রোমান্টিসিজম খুঁজে পেয়েছে শহরের ইট-কাঠ লোহা-লক্কড়ের মধ্যে, মনোজ তাই খুঁজে পেয়েছে বনে-বাদায় খালে-বিলে পতিতে-আবাদে। সভ্যতার কৃত্রিমতায় কল্লোল দেখেছে মানুষের ট্রাজেডি, প্রকৃতির পরিবেশে মনোজ দেখেছে মানুষের স্বাভাবিকতা। একদিকে নেতি, অন্যদিকে আপ্তি। যোগবলের আরেক দৃপ্ত উদাহরণ মনোজ বস্তু। কর্মই ফলদাতা, তাই কর্মে সে অনম্য, কর্মই তার আত্মলক্ষ্য। যে তীব্র পুরুষকারন তার নিশ্চয়সিদ্ধি।
একদিন, গুপ্ত ফ্রেণ্ডসএ, আশু ঘোষের দোকানে, বিষ্ণু দে একটি সুকুমার যুবকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে। নাম ভবানী মুখোপাধ্যায়। মিতবাক মিথ্যহান্য নির্মলমানস। শুনলাম লেখার হাত আছে। তবলায় শুধু চাঁটি মারবার হাত নয়, দস্তুরমতো বোল ফোঁটাবার হাত। নিয়ে এলাম তাকে কল্লোলে। তার গল্প বেরুলো, দলের খাতায় সে নাম লেখালে। কিন্তু কখন যে হৃদয়ের পাতায় তার নাম লিখল কিছুই জানি না। যখন আমাদের ভাব বদলায় তখন সঙ্গেসঙ্গে বন্ধুও বদলায়, কেননা বন্ধু তো ভাবেরই প্রতিচ্ছায়া। কিন্তু ভবানীর বদল নেই। তার কারণ বন্ধুর চেয়েও মানুষ যে বড় তা সে জানে। বড় লেখক তো অনেক দেখেছি, বড় মানুষ দেখতেই সাধ আজকাল। আর সে বড়ত্ব গ্রন্থের আয়তনে নয়, হৃদয়ের প্রসারতায়। যশবুদ্বুদ আর জনপ্রিয়তা মুহূর্তের ছলনা। টাকাপয়সা ক্ষণবিহারী রঙচঙে প্রজাপতি। থাকে কি? টেকে কি? টেকে শুধু চরিত্র, কর্মোদযাপনের নিষ্ঠা। আর টেকে বোধ হয় পুরানো দিনের বন্ধুত্ব। পুরোনো কাঠ ভালো পোড়ে, তেমনি পুরোনো বন্ধুতে বেশি উষ্ণতা। আনন্দ বস্তুতে নয়, আনন্দ আমাদের অন্তরের মধ্যে। সেই আনন্দময় অন্তরের স্বাদ পাওয়া যায় ভবানীর মত বন্ধু যখন অনন্তর।
এই সম্পর্কে অবনীনাথ রায়ের কথা মনে পড়ছে। চিরকাল প্রায় প্রবাসেই কাটালেন কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বরাবর নিবিড় সংযোগ রেখে এসেছেন। চাকরির খাতিরে যেখানে গেছেন সেখানেই সাহিত্য সভা গড়েছেন বা মরা সভাকে প্রাণরসে উজ্জীবিত করেছেন। হাতে নিয়েছেন আধুনিক সাহিত্যপ্রচারের বতিকা। কলকাতায় এসেও যত সাহিত্য-ঘেষা সভা পেয়েছেন, রবিবাসর বা সাহিত্যসেবক সমিতি,—ভিড়ে গিয়েছেন আনন্দে। নিজেও লিখেছেন অজস্র সবুজ পত্র থেকে কল্লোলে। সাহিত্যিক শুনলেই সৌহার্দ্য করতে ছুটেছেন। আমার তিরিশ গিরিশে প্রথম খোঁজ নিতে এসে শুনলেন আমি দিল্লি গিয়েছি। মীরাট যাবার পথে দিল্লিতে নেমে আমাকে খুঁজে নিলেন সমরু প্লেসে, ভবানীদের বাড়িতে।
কল্লোলে অনেক লেখকই ক্ষণদ্যুতি প্রতিশ্রুতি রেখে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে। অমরেন্দ্র ঘোষ তার আশ্চর্য ব্যতিক্রম। কল্লোলের দিনে একটি জিজ্ঞসু ছাত্র হিসেবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। দেখি সে গল্প লেখে, এবং যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ার মত, বস্তু আর ভঙ্গি দুইই অগতানুগ। খুশি হয়ে তার ‘কলের নৌকা’ ভাসিয়ে দিলাম কল্লোলে। ভেবেছিলাম ঘাটে-ঘাটে অনেক রত্নপণ্যভার সে আহরণ করবে। কোথায় কোন দিকে যে ভেসে গেল নৌকো, কেউ বলতে পারল না। ডুবে তলিয়ে গেল কি-না তাই বা কে বলবে। প্রায় দুই যুগ পরে তার পুনরাবির্ভাব হল। এখন আর সে কলের নৌকা হয়ে নেই, এখন সে সমুদ্রাভিসারী সুবিশাল জাহাজ হয়ে উঠেছে নতুনতরো বন্দরে তার আনাগোনা। ভাবি জীবনে কত বড় যোগসাধন থাকলে এ উন্মোচন সম্ভবপর।
কল্লোল-আপিসে তুমুল কলরব চলেছে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কে একজন খিড়কির দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকছে গুটিসুটি। পাছে তাকে দেখে ফেলে হুল্লোড়ের উত্তালতায় বাধা পড়ে, একটি অট্টহাসি বা একটি চীৎকারও বা অর্ধপথে থেমে যায়—তাই তার সঙ্কোচের শেষ নেই। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সে চুপিচুপি। কিংবা এই বলাই হয়তো ঠিক হবে, নিজেকে মুছে ফেলছে সে সন্তর্পণে। সকালবেলায়ও আবার আড্ডা, তেমনি অনিবার্য অনিয়ম। আবার লোকটি বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে, তেমনি কুণ্ঠিত অপ্রস্তুতের মত—যেন তার অস্তিত্বের খবরটুকুও কাউকে না বিব্রত করে। কে এই লোকটি? কর্তা হয়েও যে কর্তা নয়, কে এই নির্লেপ-নির্মুক্ত উদাসীন গৃহস্থ? সবহুমানে তাঁকে স্মরণ করছি—তিনি গৃহস্বামী—দীনেশরঞ্জনের তথা কল্লোলের সবাইকার মেজদাদা। কারুর সঙ্গে সংশ্রব-সম্পর্ক নেই, তবু সবাইকার আত্মীয়, সবাইকার বন্ধু। বস্তুর আকারে কোনো কিছু না দিয়ে একটি রমণীয় ভাবও যদি কাউকে দেওয়া যায় তা হলেও বোধ হয় বন্ধুরই কাজ করা হয়। কল্লোলের মেজদাদা কল্লোলকে দিয়েছেন একটি রমণীয় সহিষ্ণুতা, প্রসন্ন প্রশ্রয়।