পবিত্রব চিঠির ঐ লাইনটিই তারাশঙ্করের জীবনে সঞ্জীবনীর কাজ করলে। যে আগুনে সমস্ত সংকল্প ভস্ম হবে বলে ঠিক করেছিল সেই আগুনই জাললে এবার আশ্বাসিকা শিখা। সত্য পথ দেখতে পেল তারাশঙ্কর। সে পথ সৃষ্টির পথ, ঐশ্বর্যশালিতার পথ। যোগশাস্ত্রের ভাষায় ব্যুত্থানের পথ। পবিত্রর চিঠির ঐ একটি লাইন, কল্লোলের ঐ একটি স্পর্শ, অসাধ্যসাধন করল–যেখানে ছিল বিমোহ, সেখানে নিয়ে এল একা, যেখানে বিমর্ষতা, সেখানে প্রসঙ্গসমাধি। যেন নতুন করে গীতার বাণী বাহিত হল তার কাছে : তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব, জিত্বা শত্রূন ভূঙ্ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধং–তারাশঙ্কর দৃঢ়পরিকর হয়ে উঠে দাঁড়াল। আগুনকে সে আর ভয় করলে না। জীবনে প্রজ্বলিত অগ্নিই তো গুরু।
রসকলির পর ছাপা হল হারানো সুর। তার পরে স্থলপদ্ম। মাঝখানে তারুণ্যবন্দনা করলে এক মাঙ্গল্যসূচক কবিতায়। সে কবিতায় তারাশঙ্কর নিজেকে তরুণ বলে অভিখ্যা দিলে এবং সেই সম্বন্ধে কল্লোলের সঙ্গে জানালে তার ঐকাত্ম্য। যেমন শোক থেকে শ্লোকের, তেমনি তারুণ্য থেকেই কল্লোলের আবির্ভাব। তারুণ্য তখন বীর্য বিদ্রোহ ও বলবত্তার উপাধি। বিকৃতি যা ছিল তা শুধু শক্তির অসংযম। কিন্তু আসলে সেটা শক্তিই, অমিততেজার ঐশ্বর্য। সেই তারুণ্যের জয়গান করলে তারাশঙ্কর। লিখলে :
হে নূতন জাগরণ, হে ভীষণ, হে চির-অধীর,
হে রুদ্রের অগ্রদূত, বিদ্রোহের ধ্বজাবাহী বীর…
ঝঞ্ঝার প্রবাহে নাচে কেশগুচ্ছ, গৈরিক উত্তরী,
সেথা তুমি জীর্ণে নাশি নবীনের ফুটাও মঞ্জরী,
হে সুন্দর, হে ভীষণ, হে তরুণ, হে চারু কুমার,
হে আগত, অনাগত, তরুণের লহ নমস্কার।।
এর পর একদিন তারাশঙ্করকে আসতে হল কল্লোল-আপিসে। যেখানে তার প্রথম পরিচিতির আয়োজন করা হয়েছিল সেই প্রশস্ত প্রাঙ্গণে। কিন্তু তারাশঙ্কর যেন অনুভব করল তাকে উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে বরণ-বর্ধন করা হচ্ছে না। একটু যেন মনোভদ হল তারাশঙ্করের।
বৈশাখ মাস, দুপুরবেলা। তারাশঙ্কর কল্লোল-আপিসে পদার্পণ করলে। ঘরের এক কোণে দীনেশরঞ্জন, আরেক কোণে পবিত্র চেয়ারটেবিলে কাজ করছে, তক্তপোশে বসে আছে শৈলজানন্দ। আলাপ হল। সবার সঙ্গে, কিন্তু কেমন যেন ফুটল না সেই অন্তরের আলাপ চক্ষু। পবিত্র উঠে নমস্কার নিয়ে চলে গেল, কোথায় কি কাজ আছে তার। দীনেশরঞ্জন আর শৈলজা কি-একটা অজ্ঞাত কোডে চালাতে লাগল কথাবার্তা। তারাশঙ্করের মনে হল এখানে সে যেন অনধিকার প্রবেশ করেছে। কল্লোলের লেখকদের মধ্যে তখন একটা দল বেঁধে উঠেছিল। তারাশঙ্করের মনে হল সে বুঝি সেই দলের বাইরে।
কবিতা আওড়াতে-আওড়াতে উস্কোখুস্কো চুলে স্বপ্নালু চোখে ঢুকল এসে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ। এক হাতে দইয়ের ভাড়, কয়েকটা কলা, আরেক হাতে চিড়ের ঠোঙা। জিনিসগুলো রেখে মাথার লম্বা চুল মচকাতে মচকাতে বললে, চিড়ে খাব।
দীনেশরঞ্জন পরিচয় করিয়ে দিলেন। চোখ বুজে গভীরে যেন কি রসাস্বাদ করলে নৃপেন। তদগতের মত বললে, বড় ভাল লেগেছে রসকলি। খাসা!
ঐ পর্যন্তই।
কতক্ষণ পরে উঠে পড়ল তারাশঙ্কর। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলে।
ঐ একদিনই শুধু। তারপর আর যায়নি কোনোদিন ওদিকে। হয়তো অন্তরে-অন্তরে বুঝেছে, মন মেলে তো মনের মানুষ মেলে না। কল্লোলে লেখা ছাপা হতে পারে কিন্তু কল্লোলের দলের সে কেউ নয়।
অন্তত উত্তরকালে তারাশঙ্কর এমনি একটা অভিযোগ করেছে বলে শুনেছি। অভিযোগটা এই কল্লোল নাকি গ্রহণ করেনি তারাশঙ্করকে। কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়, কিংবা এক দিক থেকে যথার্থ হলেও আরেক দিক থেকে সঙ্কুচিত। মোটে একদিন গিয়ে গোটা কল্লোলকে সে পেল কোথায়? প্রেমেন-প্রবোধের সঙ্গে বা আমার সঙ্গে তার তো চেনা হল প্রথম কালি-কলমের বারবেলা আসরে। বুদ্ধদেবের সঙ্গে আদৌ আলাপ হয়েছিল কি না জানা নেই। তা ছাড়া কল্লোলের সুরের সঙ্গে যার মনের তার বাঁধা, সে তো আপনা থেকেই বেজে উঠবে, তাকে সাধ্যসাধনা করতে হবে না। যেমন, প্রবোধ। প্রবোধও পরে এসেছিল কিন্তু প্রথম দিনেই অনুকূল ঔৎসুক্যে বেজে উঠেছিল, ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল ঢেউ হয়ে। তারাশঙ্কর যে মিশতে পারেনি তার কারণ আহ্বানের অনান্তরিকতা নয়, তারই নিজের বহির্মুখিতা। আসলে সে বিদ্রোহের নয়, সে স্বীকৃতির, সে স্থৈর্যের। উত্তাল উর্মিলতার নয়, সমতল তটভূমির, কিংবা, বলি, তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গের।
দল যাই হোক, কল্লোল যে উদার ও গুণগ্রাহী তাতে সন্দেহ কি। নবীনবণ ও সবুদ্ধিসম্পন্ন বলেই তারাশঙ্করকে স্থান দিয়েছিল, দিয়েছিল বিপুল-বহুল হবার প্রেরণা। সেদিন কল্লোলের আহ্বান না এসে পৌঁছুলে আরো অনেক লেখকেরই মত তারাশঙ্করও হয়তো নিদ্রানিমীলিত থাকত।
তারাশঙ্করে তখনো বিপ্লব না থাকলেও ছিল পুরুষকার। এই পুবুষকারই চিরদিন তারাশঙ্করকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে। পুরুষকারই কর্মযোগর বিস্তৃতি। কাষ্ঠের অব্যক্ত অগ্নি উদ্দীপিত হয় কাষ্ঠের সংঘর্ষে, তেমনি প্রতিভা প্রকাশিত হয় পুরুষকারের প্রাবল্যে। নিক্রিয়ের পক্ষে দৈবও অকৃতী। নিষ্ঠার আসনে অচল অটল সুমেরুবৎ বসে আছে তারাশঙ্কর–সাহিত্যের সাধনার থেকে একচুল তার বিচ্যুতি হয়নি। ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং–তারাশঙ্করের এই সংকল্পসাধনা। যাকে বলে স্বস্থানে নিয়তাবস্থা—তাই সে রেখেছে চিরকাল। তীর্থের সাজ সে এক মুহূর্তের জন্যেও ফেলে দেয়নি গা থেকে। ছাত্রের তপস্যায় সে দৃঢ়নিশ্চয়। রিপদে চলেছে সে পর্বতারোহণে। সম্প্রতি এত বড় ইষ্টনিষ্ঠা দেখিনি আর বাংলাসাহিত্যে।