জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কমলিনীর মুখ। সহজের সুষমা মাখান সে-মুখে। যেন বা সর্বসমর্পণের শান্তি। মাথার কাপড়টা আরো একটু টেনে নিয়ে আরো একটু গোপনে থেকে সে হাসল। বললে, বৈষ্ণবের ওই তো সম্বল প্রভু।
কথাটা লাগল এসে বাঁশির সুরের মত। যে সুর কানের নয়, মর্মের-কানের ভিতর দিয়ে যা মর্মে এসে লেগে থাকে। শুধু লোত্রের কথা নয়, যেন তত্ত্বের কথা—একটি সহজ সরল আচরণে গহন-গৃঢ় বৈষ্ণব তত্বের প্রকাশ। কোন সাধনায় এই প্রকাশ সম্ভবপর হল—ভাবনায় ভোর হয়ে গেল তারাশঙ্কর। মনে নেশার ঘোর লাগল। এ যেন কোন আনন্দসায় গভীর প্রাপ্তির স্পর্শ!
এল বুড়ো বাউল বিচিত্রবেশী রসিক দাস। যেমন নামে-ধামে তেমনি কথায়-বার্তায়, অত্যুজ্জ্বল রসিক সে। আনন্দ ছাড়া কথা নেই। সংসারে সৃষ্টিও মায়া সংহারও মায়া-সুতরাং সব কিছুই আনন্দময়।
এ কে কমলিনীর?
কমলিনীর আখড়ায় এ ঝাড়ুদার। সকাল-সন্ধেয় ঝাড়ু দেয়, জল তোলে, বাসন মাজে–আর গান গায়। মহানন্দে থাকে।
তারাশঙ্কর ভাবলে এদের নিয়ে গল্প লিখলে কেমন হয়। এ মধুভাব সাধন–শ্রদ্ধাযুক্ত শান্তি–এর বসতত্ত্ব কি কোনো গল্পে জীবন্ত করে রাখা যায় না?
কিন্তু শুরু করা যায় কোত্থেকে?
হঠাৎ সামনে এল আধ-পাগলা পুলিন দাস। ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে।
রাতে চুপচাপ বসে আছে তারাশঙ্কর, কমলিনীর আখড়ার কথাবার্তা তার কানে এল।
পুলিন আড্ডা দিচ্ছিল ওখানে। বাড়ি যাবার নাম নেই। রাত নিঝুম হয়েছে অনেকক্ষণ।
কমলিনী বলছে, এবার বাড়ি যাও।
না। পুলিন মাথা নাড়ছে।
না নয়। বিপদ হবে।
বিপদ? কেনে? বিপদ হবে কেনে?
গোসা করবে। করবে নয় করেছে এতক্ষণ।
কে?
তোমার পাঁচসিকের বষ্টুমি। বলেই কমলিনী ছড়া কাটল : পাঁচসিকের বোষ্টুমি তোমার গোসা করেছে হে গোসা করেছে–
তারাশঙ্করের কলমে গল্প এসে গেল। নাম রসকলি। গল্পে বসিয়ে দিলে কথাগুলো।
তারপর কি করা! সব চেয়ে যা আকাঙ্ক্ষনীয়, প্রবাসীতে পাঠিয়ে দিল তারাশঙ্কর। সেটা বোধ হয় বৈশাখ মাস, ১৩৩৪ সাল। সঙ্গে ডাক-টিকিট ছিল, কিন্তু মামুলি প্রাপ্তিসংবাদও আসে না। বৈশাখ গেল, জ্যৈষ্ঠও যায়-যায়, কোন খবর নেই। অগত্যা তারাশঙ্কর জোড়া কার্ডে চিঠি লিখলে। কয়েকদিন পরে উত্তর এল—গল্পটি সম্পাদকের বিবেচনাধীন আছে। জ্যৈষ্ঠর পর আষাঢ়, আষাঢ়ের পর—আবার জোড়া কার্ড ছাড়ল তারাশঙ্কর। উত্তর এল, সেই একই বয়ান-সম্পাদক বিবেচনা করছেন। ভাদ্র থেকে পৌষে আরো পাঁচটা জোড়াকার্ডে একই খবর সংগৃহীত হল—সম্পাদক এখনো বিবেচনাময়। পৌষের শেষে তারাশঙ্কর জোড়া পায়ে একেবারে হাজির হল এসে প্রবাসী আপিসে।
আমার গল্পটা–সভয় বিনয়ে প্রশ্ন করল তারাশঙ্কর।
ওটা এখনো দেখা হয়নি।
অনেক দিন হয়ে গেল—
তা হয়। এ আর বেশি কি! হয়তো আরো দেরি হবে।
আরো?
আরো কতদিনে হবে ঠিক বলা কঠিন।
একমুহূর্ত ভাবল তারাশঙ্কর। কাঁচের বাসনের মত মনের বাসনাকে ভেঙে চুরমার করে দিলে। বললে, লেখাটা তাহলে ফেরৎ দিন দয়া করে।
বিনাবাক্যব্যয়ে লেখাটি ফেরৎ হল। পথে নেমে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারাশঙ্কর। মনে মনে সংকল্প করল লেখাটাকে নাটকের মতন অগ্নিদেবতাকে সমর্পণ করে দেবে, বলবে : হে অর্চি, শেষ অর্চনা গ্রহণ কর। মনের সব মোহ ভ্রান্তি নিমেষে ভস্ম করে দাও। আর তোমার তীব্র দীপ্তিতে আলোকিত কর জীবনের সত্যপথ।
অগ্নিদেবতা পথ দেখালেন। দেশে ফিরে এসেই তারাশঙ্কর দেখল কলেরা লেগেছে। আগুন পরের কথা, কোথাও এতটুকু তৃষ্ণার জল নেই। দুহাত খালি, সেবা ও স্নেহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারাশঙ্কর। গল্পটাকে ভস্মীকৃত করার কথা আর মনেই রইল না। বরং দেখতে পেল সেই পুঞ্জীকৃত অজ্ঞান ও অসহায়তার মধ্যে আরো কত গল্প। আরো কত জীবনের ব্যাখ্যান।
একদিন গাঁয়ের পোস্টাপিসে গিয়েছে তারাশঙ্কর। একদিন কেন প্রায়ই যায় সেখানে। গাঁয়ের বেকার ভবঘুরেদের এমন আড্ডার জায়গা আর কি আছে! নিছক আড্ডা দেওয়া ছাড়া আরো দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক, দলের চিঠিপত্র সদ্য-সদ্য পিওনের হাত থেকে সংগ্রহ করা; দুই, মাসিক-পত্রিকা-ফেরৎ লেখাগুলো গায়ের কাপড়ে ঢেকে চুপিচুপি বাড়ি নিয়ে আসা। এমনি একদিন হঠাৎ নজরে পড়ল একটা চমৎকার ছবি আঁকা মোড়কে কি-একটা খাতা না বই। এসেছে নির্মলশিববাবুর ছোট ছেলে নিত্যনারায়ণের নামে। নিত্যনারায়ণ তখন স্কুলের ছাত্র, রাশিয়াভ্রমণের খ্যাতি তখন তার জয়টীকা হয়নি। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল তারাশঙ্কর। এ যে মাসিক পত্রিকা। এমন সুন্দর মাসিক পত্রিকা হয় নাকি বাংলাদেশে! চমৎকার ছবিটা প্রচ্ছদপটের– সমুদ্রতটে নটরাজ নৃত্য করছেন, তাঁর পদপ্রান্তে উন্মথিত মহাসিন্ধু তাণ্ডবতালে উদ্বেলিত হচ্ছে—ধ্বংসের সংকেতের সঙ্গে এ কি নতুনতনো সৃষ্টির আলোড়ন। নাম কি পত্রিকার? এক কোণে নাম লেখা : কল্লোল। কল্লোল অর্থ শুধু ঢেউ নয়, কল্লোলের আরেক অর্থ আনন্দ।
ঠিকানাটা টুকে নিল তারাশঙ্কর। নতুন বাঁশির নিশান শুনল সে। মনে পড়ে গেল রসকলির কথা—সেটা তো পোড়ানো হয়নি এখনো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে গল্পের শেষ পৃষ্ঠাটা সে নতুন করে লিখলে। ও পৃষ্ঠার পিঠে প্রবাসীতে পাঠাবার সময়কার পোর্ক পড়েছে, তাই ওটাকে বদলানো দরকার—পাছে এক জায়গার ফেরৎ লেখা অন্য জায়গায় না অরুচিকর হয়। জয় দুর্গা বলে পাঠিয়ে দিল লেখাটা। যা থাকে অদৃষ্টে।
অলৌকিক কাণ্ড–চারদিনেই চিঠি পেল তারাশঙ্কর। শাদা শোস্টকার্ডে লেখা। সে-কালে শাদা পোস্টকার্ডের আভিজাত্য ছিল। কিন্তু চিঠির ভাষায় সমস্থ আত্মীয়তার সুর। কোণের দিকে গোল মনোগ্রামে কল্লোল আঁকা, ইতিতে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। মোটমাট, খবর কি? খবর আশার অধিক শুভ-গল্পটি মনোনীত হয়েছে। আরো সুখদায়ক, আসচে ফাল্গুনেই ছাপা হবে। শুধু তাই নয়, চিঠির মাঝে নির্ভুল সেই অন্তরঙ্গতার স্পর্শ যা স্পর্শমণির মত কাজ করে : এতদিন আপনি চুপ করিয়া ছিলেন কেন?